পৌষ সংখ্যা ১৪২৭ বিষয়: পিঠে পুলি নবান্ন, পৌষ মানে কি পূর্বাহ্ণ?

hirayagarvo
hirayagarvo
  • অন্দরমহল
  • বর্তমান সংখ্যা
  • আগামী সংখ্যা
  • লেখা পাঠান
  • চালচিত্র
  • যোগাযোগ
  • More
    • অন্দরমহল
    • বর্তমান সংখ্যা
    • আগামী সংখ্যা
    • লেখা পাঠান
    • চালচিত্র
    • যোগাযোগ

  • অন্দরমহল
  • বর্তমান সংখ্যা
  • আগামী সংখ্যা
  • লেখা পাঠান
  • চালচিত্র
  • যোগাযোগ

চরৈবেতি

===================================

পৌষ ১৪২৭ 


সম্পাদনাঃ মিহির দে ও পৌলোমী সরকার

===================================


নিবন্ধ

চেনা-অচেনা সমুদ্রের টানে

~ সেমন্তী মিত্র



শেষ হতে চললো এ বছর, কেমন যেন ভয়ে শঙ্কিত হয়ে কেটে গেল অতিমারীর বছরটা। হারিয়ে গেল বহুকিছু, নতুন করে ফিরে এলো নানা অভ্যাস, নতুন প্রাণ যেমন এলো তেমনি আবার হারিয়ে গেলেন বহু মানুষ। পুরনো শখ লালন পালন করতে পারলেও চেনা পরিচিত মুখগুলো অদেখাই থেকে গেলো এযাবৎ। কতো মানুষ কাজ হারিয়ে জীবনের মূল স্রোত থেকে পিছু হঠলেন, আবার জীবিকার জগতে নতুন দিগন্তের সূচনা হল। আসলে জীবনের ব্যালেন্স শিটে লাভ ক্ষতির হিসেব করা বড়ই দুষ্কর, কিছুতেই মেলে না। 

হেমন্তের বিদায়ে ও শীতের সূচনায় এক বিষণ্ণতা গ্রাস করে যেন – “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা” অতিমারী না হলে এ উপলব্ধি হতো না, চারিদিকে একটাই বার্তা ভেসে আসে-যদি ভালবাসাও এমন সংক্রামক হতো! ফিজিক্যাল ডিস্টেন্সিং কে মান্যতা দিতে গিয়ে কবে যে আমরা একটু একটু করে স্বার্থপরতার চরম শিখরে পৌঁছে গেলাম জানিনা, এ থেকে বুঝি ফেরার পথ নেই? ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র মতো করেই যেন সুর ভাঁজি আজকাল, 

“পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে

স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে

ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী”


কিন্তু কতদিন ভালোলাগে এমন বন্দীজীবন? প্রিয়জনের সান্নিধ্য, স্মৃতিচারণ, ভালোলাগার বিষয়গুলো নিয়ে কিছুটা সময় অতিবাহিত হলেও অনন্তকাল তো এমন ঘরে বন্ধ হয়ে থাকা যায় না, তাই পূজার সময় চলে গেছিলাম শঙ্করপুর, আরো একবার। পাহাড় সমুদ্র দুইই সমান প্রিয়, কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে বাস করার দরুন সমুদ্র অপেক্ষাকৃত নিকটে, তাই ছুটির কদিন সমুদ্রের সান্নিধ্যে কাটাবো এমন স্থির হল। সাগরের কিনারে কখনো একঘেয়ে লাগে না। পাহাড় যেমন গম্ভীর-ধীর-স্থির-নীরব-ধ্যানমগ্ন, সমুদ্র ঠিক তার উল্টোটা, অবিরাম গতিতে ঢেউ আসে ঢেউ যায়, তবুও কখনো পরিশ্রান্ত হয় না।


কলকাতা থেকে শঙ্করপুরের দূরত্ব একশ পঁচাশি কিলোমিটার মতন, গাড়িতে সময় লেগেছিল ঘণ্টা পাঁচেক। সপ্তমীর সকালে যখন চতুর্দিকে কাঁসর-ঘণ্টা-ঢাকের বাদ্যি, ধূপ-ধুনোর গন্ধ, তখন আমরা সমস্ত সুরক্ষাবিধি মেনে শহরের কোলাহল পেরিয়ে গন্তব্যের পথে। বছর পাঁচেক আগে গ্রীষ্মকালে আমরা প্রথমবারের জন্য শঙ্করপুর যাই, নির্জন সৈকত-ঝাউবন-উত্তাল সমুদ্রের বেষ্টনীতে থাকা মনোরম পরিবেশ আমাদের মোহিত করেছিল, তাই দ্বিতীয়বার যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত।

সকাল সাতটায় রওয়ানা দিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বেলা সাড়ে বারোটা বেজে গেছিলো, উঠেছিলাম হোটেল নেস্টে, সেই প্রথমবারের মতন। পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করেই চলে গেছিলাম সমুদ্রের ধারে। আসলে আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না, প্রায় ছয়মাস ঘর ছেড়ে সেভাবে দূরে কোথাও বেরোতে পারিনি, একটু মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য মন ছটফট করছিলো। 


তখন বেলা দুটো, বেশ কড়া রোদ, সামনে সমুদ্রের চিকচিকে ঢেউ- বহু প্রতীক্ষিত দৃশ্য, আনন্দে পদ ছোঁয় না ধরণী অবস্থা, কিন্তু পাঁচ বছরে শঙ্করপুরের অনেকটা পরিবর্তন নজরে এলো। সেই বিস্তীর্ণ সমুদ্রতট, ঝাউবন কিছুই আর নেই। হোটেলের পক্ষ থেকে যিনি আমাদের দেখাশোনার তত্ত্বাবধানে ছিলেন তাঁর কাছ থেকেই শুনলাম যে শঙ্করপুরে সমুদ্র প্রতিনিয়ত সম্মুখ বরাবর অগ্রসর হচ্ছে, তাই তট ভাঙনের মুখে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ঝাউবন। এই ভাঙন কে প্রতিহত করতে সমুদ্রতটে বড় বড় পাথর ফেলা হয়েছে, তট আর ঠিক আগেরমত বালুকাময় নেই, বরং পাথুরে। জোয়ারের সময় এই পাথরে ঢেউ আছড়ে পড়ে, পাথর গুলোর মধ্যেই নানাবিধ সামুদ্রিক উদ্ভিদ-প্রানীর বাস, ভাঁটায় আবার সমুদ্র একটু শান্ত, তখন বালির পার ধরে কিছুক্ষণ হাঁটা যায় তবুও। তটে ছোটছোট পিঁপড়ের মতো দেখতে ধূসর বর্ণের অজস্র কাঁকড়া, ঢেউ আসার উপক্রম হলে কিম্বা আমাদের পদধ্বনিতে গহ্বরে লুকিয়ে পড়তে শশব্যস্ত-সবমিলিয়ে অন্যরকম। 


দীঘা কিম্বা শঙ্করপুরে সমুদ্রের ধারের ঝাউবন গুলোই অন্যরকম সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে, তাই ঝাউবন গুলো এমন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখে বেশ আক্ষেপ হচ্ছিল। নিজের মনেই ভাবছিলাম যে সুনামি, আয়লা, ফনী, বুলবুল তারপর আম্ফান কি সহ্য করেনি এই সমুদ্র, এতো উত্থান পতনের পরও কেমন নিজের কাজে অবিচল, সত্যি কতো উদার।

তবে হোটেলের বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখার আশা নিয়ে শঙ্করপুর আসলে আশাহত হতে হবে, এখানে এখনো পর্যন্ত সমুদ্রের কাছে কোনো হোটেল নেই, হোটেল নেস্ট তট থেকে অনেকটাই দূরে, হোটেলের নিজস্ব যান আছে সমুদ্র তটে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কাছাকাছি থাকবার জায়গা বলতে পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য বিভাগের দুটি ট্যুরিস্ট লজ আছে- তটিনী ও কিনারা, সেগুলোও তট থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথে। হোটেল নেস্ট থেকে সমুদ্রে যেতে হলে মৎস্য বিভাগ অধিকৃত বহু গাছগাছালি দ্বারা পরিবেষ্টিত স্থানটি পেরিয়ে তারপর পৌঁছতে হয়। সমুদ্র তটে যাওয়ার পথে খাঁড়িতে বড় বড় নৌকা, জাল দেখেই বোঝা যায় যে এই তট মৎস্যজীবী দের জন্য একেবারে আদর্শ। 

তট থেকে একটু দূরে ছাউনি ঘেরা বসার জায়গা, হেলানো আরাম কেদারা, সেই আগের মতো একদম। ভাবলাম যে ডাব খেতে খেতে ঢেউ গোনা যাক, দুটি মাত্র দোকান সেই স্থানে। ডাব কিনতে গিয়েই প্রথম হোঁচট খেলাম, কতো দাম জিজ্ঞাসা করতেই দোকানী উত্তর দিলেন, “কুড়ি টাকা” পাঁচ বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন চল্লিশ টাকার কমে ডাব খাই নি!হেতু জিজ্ঞেস করতেই জানলাম যে ঝড়ে দোকান ভেঙে গেছিলো, এমনিতেই পাথুরে তটের জন্য আগের মতো আর পর্যটকরা আসেন না, তাছাড়া এই অতিমারীর প্রভাবে গত ছয়মাস তো তেমন পর্যটক আসেন নি, অগত্যা দাম কমিয়েই বিক্রিবাট্টা চলছে, তাতে অন্তত কিছুটা হলেও অন্নসংস্থান হবে। আমরা পূজায় কি আনন্দ করবো ভাবছি আর এঁরা সামান্য ভাতের জন্য প্রতিনিয়ত কি জীবন সংগ্রাম করে চলেছেন, অবিশ্বাস্য। মনটা ভারাক্রান্ত হল। কিছু বিস্কুট কিনলাম, আর ফ্রেশ মাছ ভাজার অর্ডার দিলাম, দোকানির খুশী ছিল দেখবার মতন।

হোটেল নেস্টের সেই কেয়ারটেকার ভদ্রলোক টি পাঁচ বছর আগেও আমাদের এমনি ভাবে দেখাশোনা করেছিলেন, সেই সময় তাঁর চেহারায় জৌলুশ ছিল, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতে ম্রিয়মাণ, শীর্ণকায়, খুব চোখে লাগছিলো। ওনার সাথে গল্পে গল্পে জানলাম যে বিগত চারমাস হোটেল বন্ধ থাকায় ওঁদের কোনো রোজগার ছিল না, জমানো কটা টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার পর যে যেভাবে পেরেছেন সেভাবে জীবিকা নির্বাহ করেছেন, কেউ মাছ ধরতেন, কেউ বাড়ির সামনের জমিতে সামান্য চাষ আবাদ করতেন, কেউ ড্রাইভারি করেছেন কিম্বা কেউ অন্য কিছু,এই অতিমারী দিশেহারা করে দিয়েছে ওঁদের।


অতিমারীর প্রকোপে মুখ থুবড়ে পড়েছে পর্যটন শিল্প, আর এরসাথে যুক্ত থাকা মানুষ গুলো চরম সঙ্কটে, ভয়াবহ দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছে তাঁদের, কবে এর থেকে পরিত্রাণ পাবেন কেউ জানেন না। সব কথা শুনতে শুনতে কান্না পাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যে বলি, “থাক, আর শুনবো না” কিন্তু ঝড়ের পর যেমন আকাশ পরিষ্কার হয়, রোদ ওঠে, সেইভাবে ভদ্রলোক বলে চললেন, “ জানেন দিদি, এই প্যানডেমিকেও আমরা কিন্তু একসাথে ছিলাম, যেদিন আমার বাড়ি রান্না হয় নি সেদিন পাশের বাড়ি থেকে খাবার দিয়ে গেছে, যেদিন পাশের বাড়ির ভদ্রলোক অসুস্থ হলেন, আমরা পাড়ার সব ছেলেরা তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম, পাশের বাড়ির বৌদি বাড়ির গাছের লাউ পাঠিয়েছেন, আমি আবার একটু মাছ ধরে আনলে সেই মাছ পাঠিয়ে দিয়েছি ওদের বাড়ি, দূরত্ব দূরত্ব করলে আমাদের হবে?” স্তম্ভিত হলাম, এবার আনন্দাশ্রুর পালা, সত্যিই তো মানুষ গুলো গরীব হলেও নিঃস্ব নয় তো। দুঃখে বিপদে এই সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনেও যে এইভাবে একে অপরের পাশে থাকা যায় এই তো জীবনের এক পরম প্রাপ্তি।


আমরা চরম ব্যস্ত শহরের মানুষ, কোনো কিছুর অভাব যদি আমাদের থেকে থাকে তা হল সময়, সেজন্য আমাদের জীবনে সম্পর্কগুলো আর আগের মতন গুরুত্ব পায় না, তাই প্যানডেমিকে আমাদের অর্থাভাব না থাকলেও মানসিকভাবে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি, নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি সোশ্যাল মিডিয়ায়, নিজেদের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আবদ্ধ করে ফেলেছি, তাই একা থেকে আরো একা, আর সেখান থেকে একটা শূন্যতা, মানসিক অবসাদের দুনিয়া, অথচ এটা কাম্য ছিল না, স্রেফ মানসিক দীনতা আমাদের এই নির্জন দ্বীপে উপনীত করেছে। 

নবমী নিশি ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ফিরে এসেছিলাম বাড়িতে। শঙ্করপুরে এবার যেমন অনেক কিছু ছিল না, আবার অনেক কিছুই তৈরি হচ্ছিল। বছর কয়েকের মধ্যে পাথুরে তট বাঁধিয়ে দেওয়া হবে,তারপর ঝাউ গাছ লাগানো হবে শুনলাম। বছর দুয়েক আগে এখানে একটি ইকো পার্ক তৈরি হয়েছে, অনেকেই এখন সেখানে বেড়াতে যান। নির্জন তট শঙ্করপুরের সবচেয়ে ভালোলাগার জায়গা, যদিও দীঘা থেকে মাত্র চোদ্দ কিলোমিটার পূর্বে কিন্তু দীঘার মতো পর্যটকদের ভিড় এখানে নেই, তাই সমুদ্র কে সম্যক ভাবে উপভোগ করা যায়, আর সূর্য ডুবে যাওয়ার পর আকাশের নীলচে গোলাপি রং এককথায় অপূর্ব, এবং আতিথেয়তার সৌজন্যে শঙ্করপুরের জন্য মনে সবসময় একটা আলাদা জায়গা থাকবে। শঙ্করপুর থেকে ফিরেছিলাম এই বিশ্বাস নিয়ে যে এখনো মানুষ পুরোপুরি বদলে যায় নি, আত্মনিমগ্ন হয়ে যায় নি, পারস্পরিক ভরসা-নির্ভরতার জায়গা টুকু তে একটু ধুলো পড়েছে মাত্র, মুছে দিলেই তা ঠিক হয়ে যাবে। 






ভ্রমণকাহিনী

উত্তরের শৈবতীর্থ জয়ন্তী

~বিবেকানন্দ বসাক



চা বাগান-অরণ্য আর পাহাড় ঘিরে থাকা প্রকৃতি জ্যোৎস্নার মতো পেলবতা নিয়ে আসে। এখানে রোদ মায়াবী আলো ছড়ায় ভোর হলে। মোহময়ী জয়ন্তী যেন ডুয়ার্সের পর্যটনী সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক।

আলিপুরদুয়ার শহর থেকে প্রায় ৩০ কিমি দূরে ডুয়ার্সের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র জয়ন্তী অবস্থিত। গত বছর শিব চতুর্দশী উপলক্ষে মাকে সঙ্গে নিয়ে জয়ন্তী বেড়াতে যাই। সকালের সোনা রোদ গায়ে মেখে ৭ টা নাগাদ উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার  বাসে রওনা দিই। জংশন রেলকলোনি পেরোনোর পর নর্থপয়েন্ট। তারপর রাস্তার পাশেই উঁকিঝুঁকি দেয় মাঝের ডাবরি চা বাগান। আরও কিছুটা পথে বাস এগোতেই দমনপুর চেকপোস্ট। অরণ্যের জড়িয়ে থাকা ব্যাকুলতায় মন ঝুঁকে থাকে। এখান থেকেই বক্সা অরণ্য আপনাকে স্বাগত জানাতে শুরু করল। রাজাভাতখাওয়ার দিকে যতই এগোবেন, ততই অরণ্য নিবিড় আবেগে জড়িয়ে ধরে। পানিঝোরা, পাম্পুবস্তি, রাজাভাতখাওয়া চেকপোস্ট, ২৩ মাইল পেরিয়ে বাস ছুটছে। গাদাগাদি ভিড়। কারণ শিব চতুর্দশীতে অসংখ্য পুণ্যার্থীর ঢ্ল নামে জয়ন্তীতে। 


পর্যটকদের কাছে ডুয়ার্স শব্দটাই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে সেই কোন কাল থেকে। ইতিহাসের কথায়, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভুটানের মানুষ সমতলে যাতায়াতের জন্য বেশকিছু পথ ব্যবহার করত। এই পথগুলিই যেহেতু ভারতে প্রবেশের পথ, তাই সেখান থেকে দুয়ার বা দ্বার বা Door শব্দটি এসেছে। ইংরেজি  Door শব্দ থেকে ডুয়ার্স কথাটির উৎপত্তি। বাংলা ও অসম রাজ্য থেকে ভুটানে প্রবেশের এরকম ১৮ টি দুয়ার রয়েছে। অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলার উত্তরদিকে তিস্তা নদী থেকে সংকোশ নদী পর্যন্ত এগারোটি দুয়ার রয়েছে। পরবর্তীকালে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল পশ্চিম দুয়ার বা ডুয়ার্স নামে অভিহিত হয়। অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলার ১৩ টি ব্লকের মধ্যে জলপাইগুড়ি সদর ও রাজগঞ্জ ব্লক বাদে বাকি ১১ টি ব্লক নিয়ে ডুয়ার্স অঞ্চল গঠিত। এই এলাকা আনুমানিক ৪,৭৫০.০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত। 


এবার আসি শৈবতীর্থের কথায়, ডুয়ার্সে যে সমস্ত শৈবতীর্থ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ময়নাগুড়ির জল্পেশ মন্দির, বটেশ্বর। লাটাগুড়ির কাছে বামনী ঝোরার মহাকালের থান। কুমারগ্রামদুয়ারের ধুমপাড়াতে ধুমবাবা। ফালাকাটা-বীরপাড়ার রাস্তায় জটেশ্বর শিবমন্দির। চামুর্চির মহাকাল ধাম। আলিপুরদুয়ার মহাকালগুড়িতে মহাকালবাবা। কামাখ্যাগুড়িতে বুড়াঠাকুর নামে পরিচিত মহাদেব। জয়ন্তীর পাহাড়ের গুহায় একটু কষ্টসাধ্য পথ পেরিয়ে জয়ন্তীর সেই বিখ্যাত শৈবতীর্থ। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য বড়ই মনোরম। জয়ন্তীতে নেমে মা এবং আমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা মহাকাল জয়ন্তীর উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরই দু-একজন চেনা পরিচিতের সঙ্গে দেখা হল। তাদের পরামর্শে ভুটভুটিতে উঠে বসলাম। শুকনো,  খটখটে নদীর বুক চিড়ে আমাদের যাত্রা পুণ্যতীর্থের দিকে। ভুটভুটি যতই এগিয়ে চলেছে, পাহাড় ততই কাছে এগিয়ে আসছে। বাস, অটো, ভ্যান, ভুটভুটির ভিড়ে পুণ্যতীর্থ জয়ন্তী তখন জেরবার। আর কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়। উত্তরবঙ্গ তো বটেই অসম, বিহার থেকে বহু তরুণ প্যান্ডেল বানিয়ে বিনামূল্যে খাবারের আয়োজন করেছে। খিচুড়ি, ফ্রায়েড রাইস, ভাত-ডাল-সব্জি। এককথায় অর্থ খরচ করে খাবার খাওয়ার কোনও সুযোগই আপনি পাবেন না। পেট তো আর ঢাক নয়।তাই খাবারও সাধ্যের মধ্যেই খেতে হবে। চা, কফি, জলও বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। তাই লোভ সামলাতে না-পেরে খিচুড়ি আর ঘুগনি দিয়ে জম্পেশ করে খেলাম। মাঝেমাঝেই চা ও কফি তো আছেই। আর যারা আগের দিন বিকেলে এসেছে, তারা অনেকেই টেন্ট বানিয়ে রাত্রিবাস করেছে। বিনামূল্যে থাকারও ব্যবস্থা রয়েছে। পাশ দিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে বালা নদী। পুরো যাত্রাপথে রাতে টিউব লাইটের আলোয় দুর্গম পাহাড়ি পথ আলোকিত হয়ে উঠেছে। সঙ্গে পরিবারের মহিলারা থাকলে রাতে নিরাপত্তার তেমন অসুবিধাও নেই। একদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আলিপুরদুয়ার জেলা পুলিশ।  অন্যদিকে ভুটান পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে। মেলাও বসেছে। শঙখ, শিবলিঙ্গ, ছেলেমেয়েদের ব্যাগ, টুপি, পোশাক,  বাচ্চাদের খেলনা থেকে শুরু করে যাবতীয় দ্রব্যসামগ্রী পর্যটকদের অতিরিক্ত আকর্ষণের কারণ। অনেকেই মেলা থেকে টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে নিচ্ছে। আর একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি। সেটা ছিল ফেব্রুয়ারি মাস। তখনও ভারতে করোনার জন্য কোনও বাধ্যবাধকতা বা নিষেধাজ্ঞার সচেতনতাই নেই। কিন্তু ভুটানের মতো ছোট্ট দেশ কী জোরালো নিরাপত্তা ও সঙ্গে থার্মাল স্ক্রিনিং শুরু করে দিয়েছিল, তা দেখে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। আসলে ওরা ভারতের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে করোনার নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। তখন থেকে কড়া হাতে ব্যবস্থা নিয়েছে এবং এখনও তা জারি রেখেছে। একটা কথা অনেকেরই মনে হতে পারে, জয়ন্তীতে ভুটানের পুলিশ কেন? তার কারণ জয়ন্তী পর্যটনকেন্দ্রটি আলিপুরদুয়ার জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও পাহাড়ের গায়ে যখনই শৈবতীর্থের দিকে পা রাখতে যাবেন, তখন রয়্যাল ভুটান লেখা গেট দিয়ে ভেতরে উঠতে হবে। দুর্গম পথে মহাকালের গর্ভগৃহে পৌঁছাতে আগের দিন থেকেই মানুষের ঢল নামতে শুরু করে। সারারাত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পুণ্যার্থীরা গর্ভগুহায় পৌঁছোয়। পরদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভিড়ের কোনও কমতি ছিল না। মানুষের এই মিলনমেলায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। 


অপরাহ্নের আলো যখন ক্রমশ নিবু নিবু হয়ে এলো আমরা রওনা দিলাম আলিপুরদুয়ারের উদ্দেশে। এই পাহাড়ি পথ, এই গভীর জঙ্গলের নির্জনতা,  পুণ্যার্থীদের ঢল আর বিস্তীর্ণ বালুকারাশির কাছে রেখে এলাম প্রতীক্ষার প্রহর। শৈবতীর্থ জয়ন্তী ছাড়াও পর্যটনকেন্দ্র জয়ন্তীও বড়ই মনোরম। জয়ন্তী বনবাংলোয় থেকে রাতের জ্যোৎস্নামাখা প্রকৃতিকে উপভোগ করার আনন্দই আলাদা। আপনিও হয়তো গেয়ে উঠবেন, 'আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে...।'  বনবাংলোয় রাত্রিবাস করতে হলে অনলাইনেই বুক করতে পারেন।এমনকী আলিপুরদুয়ার বনদপ্তরের কার্যালয়েও যোগাযোগ করা যেতে পারে। এছাড়া বেসরকারি ব্যবস্থাও রয়েছে। শিব চতুর্দশীতে গাড়ির কোনও অভাব হয় না। সবসময়ই চলতে থাকে। অন্যসময় যেতে হলে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার বাস সকাল ৭ টা নাগাদ আলিপুরদুয়ার থেকে ছাড়ে এবং দুপুর দুটোয় আরও সরকারি বাস রয়েছে। যারা রিজার্ভ করে যেতে চান, তারা শহরেই গাড়ি পেয়ে যাবেন। অথবা আলিপুরদুয়ার জংশন স্টেশন চত্বর থেকেও রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন।    



ভ্রমণকাহিনী

গৌড় ছুঁয়ে দেখা

 ~ বিনীতা সরকার 



বেশকিছুদিন আগেই ঘুরে এলাম গৌড় থেকে। এখানকার বাতাসে বাদশাহী আমলের এক অদ্ভুত আবেশ মেশানো। এক অদ্ভুত শীতলতার শিহরণ জাগে এখানে আসলেই। ভগ্নস্তূপের ভেতর থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে শত শত বছরের চাপা পড়া ইতিহাস। একবার ছুঁয়ে দিলেই যেন জীবন্ত হয়ে সম্মুখে ধরা দেয়। আছে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করা বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও। প্রাচীন গৌড় নগরীর ধ্বংসাবশেষ ইংরেজবাজার শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এখানে রয়েছে নানান দর্শনীয় পুরাস্থল এবং পুরাকীর্তির  নিদর্শন। এগুলি হল:

~ বড় সোনামসজিদ বা  বারোদুয়ারী

-----------------------------------------------------

সুলতানী যুগের এমনই এক অদ্ভুত সুন্দর নিদর্শন হল বারোদুয়ারী। গৌড়-রামকেলি অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ দ্রষ্টব্য এই বারোদুয়ারী বা বড় সোনা মসজিদ। বাদশাহী আমলে তৈরি গৌড়ের সুবৃহৎ মসজিদ এটি। মসজিদটি প্রায় ৫১ মিটার দীর্ঘ ও ২৩ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট। মসজিদটির নির্মাণ কাল সম্পর্কিত প্রস্তর লিপি অনুসারে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র সুলতান নাসির উদ্দিন নসরৎ শাহের আমলে হিজরী ৯৩২,অর্থাৎ ইংরেজি ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদের ভিতরে তিনটি লম্বা আইল দিয়ে তিনটি পৃথক পরিসর এবং সন্মুখে এগারোটি খিলান দ্বারা উন্মুক্ত পথ। এখানে একটি প্রার্থনা কক্ষ,সম্মুখে বারান্দা ও কোণ গুলিতে অষ্টভুজ বুরুজ বর্তমান। সম্মুখভাগ সমান,ছাদ ও দেওয়ালের সঙ্গমস্থলে কারুকার্য,বক্রাকৃতি কার্নিশ ও উপরে অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ। নামাজের কক্ষ প্রস্তরস্তম্ভ দ্বারা বিভক্ত। মূল কক্ষের উপরের ৩৩ টি গম্বুজ ভূপতিত। ইমামের বেদীও দেখা যায় না এখন। মসজিদটির বারোদুয়ারী নামটি বিতর্কিত। মসজিদটিতে রয়েছে এগারটি প্রবেশদ্বার।  প্রকৃতপক্ষে রাজপ্রাসাদের বহির্দেশে অবস্থান ছিল এই মসজিদটির। বার(বাহির) দুয়ার বলেই হয়ত এটিকে বারোদুয়ারী নামে ডাকা হতো।


~দাখিল দরওয়াজা গৌড়,মালদা

------------------------------

অসাধারণ একটি স্থাপত্য হল দাখিল দরওয়াজা বা সেলামী দরওয়াজা। বারোদুয়ারী থেকে কিছু দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে গৌড়ের সিংহদ্বার বা মূল দরওয়াজা। এর আরেক নাম সেলামি দারওয়াজা। এই ফটকের পার্শ্ববর্তী গড় থেকে সুলতানকে বন্দুক দেগে সম্মান জানানো হত বলে এটি সেলামী দরওয়াজা নামেও পরিচিত ছিল। এটি বাংলা রীতিতে নির্মিত প্রথম সিংহদ্বার। দাখিল দরওয়াজা সঠিক নির্মাণকাল জানা যায়নি। বর্তমানে কোন লিপিফলক সন্নিবদ্ধ নেই। এর গঠনশৈলী দেখে কেউ কেউ মনে করেন এটি রুকনুদ্দিন বরবক শাহের আমলে তৈরি। কেউ কেউ বলেন হুসেন শাহের আমলে,আবার অনেকে বলেন হুসেন শাহের পুত্র নসরৎ শাহের আমলে তৈরি।  ছোট ছোট ইঁটের তৈরি এই দরওয়াজা। এর মধ্যেগামী প্রবেশপথটি ৪ মিটার চওড়া এবং ৩৫ মিটার লম্বা। এর বিশালত্ব দর্শকমাত্রই অভিভূত করে ফেলে অতি সহজে। এই তোরণটি তৈরি করতে কিছু কিছু অংশে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। তবে লাল রঙের ইঁট দিয়েই প্রধানত তৈরি এটি। ইঁটের কাজও চমৎকার।


~ রামকেলী, গৌড়

-------------------------------

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান হল এই রামকেলী ধাম। গৌড় প্রবেশের পর প্রায় আধ কিলোমিটার দুরে পথের ডানদিকে ঘুরলেই তমালতলা ও তার পেছনে আছে মদনমোহন জীউর মন্দির। কথিত আছে যে, রামকেলিতে গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের মন্ত্রী রুপ ও সনাতন শ্রী চৈতন্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে পরবর্তী পর্বে রাজ কাজ ত্যাগ করে বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীদের অন্যতম হন। রুপ ছিলেন সগীর মালিক অর্থাৎ প্রতি রাজ এবং সনাতন ছিলেন দবীরখাস অর্থাৎ প্রধান মুন্সি। তমাল বৃক্ষ ও চৈতন্য পদচিহ্ন পরবর্তীকালে সংযুক্ত হয়েছে। প্রায় পাঁচ শতাব্দী পূর্বের শ্রীচৈতন্যের সেই শুভ পদার্পণের স্মৃতিকে সামনে রেখে এখানে জৈষ্ঠ্য মাসের সংক্রান্তিতে প্রতিবছর রামকেলি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে মদনমোহন জিউর মন্দিরের পঞ্চরত্ন মন্দিরটি ১৯৩৭সালে নতুনভাবে সংস্কার করে নির্মিত। শ্রী সনাতন গোস্বামী কর্তৃক শ্রী মদন মোহন ও রাধারানীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার কাল ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দ বলে কথিত।


~পিয়াস বাড়ী দীঘি

---------------------------------

পিয়াস বাড়িতে রাস্তার বাম দিকে এই দীঘি অবস্থিত। আইন-ই-আকবরীতে আবুল ফজল আল্লামী এর প্রথম উল্লেখ করেছেন। কথিত আছে যে, পূর্বে এই দীঘির জল বিষাক্ত ও  লবণাক্ত ছিল। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের এর পাশে বেঁধে রাখা হত ও পিপাসার্তদের এই জল পান করতে দিয়ে মারা হত। মহানুভব আকবরের নির্দেশে এই নিষ্ঠুর বিধানটি রদ হয়। তবে এ সংবাদটি কতদূর সত্যতা প্রমাণিত হয়নি ও দীঘির জলের বিষাক্ত তা নিয়েও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি।


~কদম-ই-রসুল বা কদম শরীফ

-----------------------------------------------

ফিরোজ মিনার থেকে প্রায় ১/২ কিলোমিটার দক্ষিনে বিশাল গড় এর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে বামদিকে ঘুরলেই কদম-ই-রসুল ভবন বা কদম শরীফ। সাদা পাথরের উপরে নবী হযরত মুহাম্মদ এর পবিত্র পদচিহ্ন রয়েছে ভবনটিতে। ভবনটি ৯৩৭ হিজরীতে অর্থাৎ ১৫৩১ সালে সুলতান নসরত শাহ কর্তৃক নির্মিত। এই স্থাপত্যটিও হিন্দু সংস্কৃতির পরিচায়ক। বীরভূম,বাঁকুড়া,হুগলিতে অনেক মন্দির তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কান্তজির মন্দির এরকম ধাঁচে তৈরি। সুতরাং মন্দিরের পরিবর্তিত রূপ হল এই ভবন এইরূপ মনে করা হয়। মূল ভবনের উচ্চতা ১৬ ফুট। চার কোণে রয়েছে অষ্টকোণী বুরুজ।


~ফতে খাঁর সমাধিস্থল, গৌড়

-------------------------------------------

কদম রসুল ও ফতে খাঁর সমাধি ভবন একই প্রাচীর বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থিত। পলেস্তরাযুক্ত এই সমাধি ভবনটি বাংলার দোচালা ভবনের এক বিশিষ্ট নিদর্শন। ভবনটির নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠিতলিপি নেই, কিন্তু ফতে খানের মৃত্যুর তারিখ ১৬৫৭ থেকে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হবে নিশ্চিত।


~ তাঁতীপাড়া মসজিদ

-------------------------------

শাহী দরওজা দিয়ে কিছুদূর পূর্ব দিকে এগোলে মহদীপুর এর পথে দক্ষিণ দিকে তাঁতিপাড়া মসজিদ পড়ে। টেরাকোটার অপূর্ব নিদর্শনের দিক থেকে বিচার করলে গৌড় ও পান্ডুয়ার যতগুলো মসজিদ রয়েছে তাঁদের মধ্যে সেরা তাঁতিপাড়া মসজিদ। তবে অতীতে গৌরবের চিহ্ন এখন অল্পই আছে। এই মসজিদটি আয়তকার। মসজিদটিতে গৌড়ের বারদুয়ারী বা বড় সোনা মসজিদের মত বহু গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের অর্ধেক গোলাকৃতির ১০ টি গম্বুজ ছিল, কিন্তুু ভূকম্পনে সেগুলো ভূমিসাৎ হয়েছে। ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সুলতান ইউসুফ শাহ-এর রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল এই মসজিদটি। মসজিদের বিভিন্ন দিক নানারকম অলঙ্করণে শোভিত। কেউ কেউ তো গৌড়ের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি বলেও মনে করেন এই তাঁতিপাড়া মসজিদকে। এখানকার টেরাকোটা কারুকার্যের নিদর্শন সর্বস্তরে প্রশংসিত হয়েছে। এককথায় অলঙ্করণে,ভারসাম্যে ও অলংকৃত মোটিফগুলিতে তাঁতিপাড়া মসজিদ বাঙালির শিল্প মানসের এক অনন্য নিদর্শন স্থাপন করেছে।


~লোটন মসজিদ

------------------------------

লোটন মসজিদের সৌন্দর্য সত্যিই বর্ণনাতীত।

তাঁতিপাড়া মসজিদ ছেড়ে দক্ষিণ দিকে আরো এগিয়ে গেলে পথের বাম দিকে পড়বে এই লোটন মসজিদ। কিংবদন্তি অনুসারে এক নর্তকী নাম থেকে এটি লোটন মসজিদ নামে অভিহিত। কানিংহামের মতানুসারে এটি ১৪৭৫ সালে ইউসুফ খান দ্বারা নির্মিত মসজিদ। দেশি-বিদেশি সব ঐতিহাসিকগণ অপরিচিত এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে এই নতুন মসজিদের নানান রঙের মিনে করা ইঁট এক কথায় অসাধারণ। গৌড়ের আরো অন্যান্য দালানকোঠার মত এই মসজিদটিতেও হিন্দু সংস্কৃতির চিহ্ন সুস্পষ্ট। কথিত আছে মীরাবাঈ নামে কোন এক হিন্দু নর্তকী মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেন। এই মসজিদটি নাকি তিনিই তৈরি করেছেন। মীরাবাঈ যে তালুক ভোগ করত তার নাম অনুসারে মিরা তালুক আজও তার স্মৃতি বহন করে চলেছে। অনেকে বলেন যে লোটন এই নামটি নাকি নটী শব্দের বিকৃত রূপ।


~মহদীপুর হাইস্কুলের মিউজিয়াম

----------------------------------------------------

মালদহের ইংরেজ বাজার থানার অন্তর্গত মহদীপুর হাই স্কুলের নিজস্ব মিউজিয়ামের সংগ্রহের তালিকায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গৌড় ভ্রমণে যারা যাবেন তাদের মধ্যে কেউ যদি প্রত্নতাত্ত্বিক দ্রষ্টব্য ব্যাপারে প্রচন্ড আগ্রহী হন তাহলে একটা গ্রাম অঞ্চল অবস্থিত একটি হাইস্কুলের মিউজিয়াম অর্থাৎ প্রত্নসামগ্রীর সংগ্রহটি যদি না দেখেন তাহলে অনেক কিছু দেখা থেকে বঞ্চিত হবেন । বিভিন্ন রকমের প্রত্নসামগ্রী নিয়ে বিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা তৈরি করেছেন এক বিস্ময়কর জাদুঘর। পাথরে নির্মিত বহু মূর্তি তো আছেই তাছাড়া আছে পাথরের তৈরি একটি বাক্স। টেরাকোটা ইঁটের অপরূপ সব নিদর্শন মধ্যযুগের ব্যবহৃত হত। আছে সুলতানদের আমলে ব্যবহৃত প্রচুর তাম্র ও রৌপো মুদ্রা। এখানে রয়েছে মাটির তৈরি এবং সেরামিক বহু বাসনপত্রের ভগ্নাবশেষ। ব্রোঞ্জের তৈরি মূর্তি। আছে ফুল পাতা আঁকা এনামেল করা অজস্র ইঁট। এগুলি সবই পার্শ্বস্থ গৌড় থেকে সংগ্রহ করা। এখানে আছে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তির সাথে ধ্যানী বুদ্ধদেবের মূর্তিও।


~চামাকাটি মসজিদ

-----------------------------------

এই মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী অনেকটা লোটন মসজিদের অনুরূপ। গৌড়ের অন্যান্য মসজিদের গম্বুজের থেকে এর গম্বুজের আকৃতি একটু আলাদা ধরনের। এটির বিশেষত্ব হল বাইরে থেকে পরপর প্রায় সমদূরত্বে পাঁচটি ধাপ গম্বুজকে বেষ্টন করে আছে। মূল প্রকোষ্ঠের তিন দিকে তিনটি দরজা আছে। বিদেশি গবেষকদের মতে এটি ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইউসুফ কর্তৃক নির্মিত হয়।


~ পাঁচ খিলানের সেতু

---------------------------------

এটি ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে আবুল মোজাফফর আহমদ শাহের দ্বারা নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। লোটন মসজিদ থেকে দক্ষিণমুখী রাস্তা দিয়ে মহদীপুর যাওয়ার পথে এই সেতুটি পড়ে। রাস্তাটির এত বেশি সংস্কার হয়েছে যেহেতু আর উপর থেকে তেমন ভাবে বোঝা যায় না। অন্য সেতুটি আছে মহদীপুর থেকে মাটির পথে গুণমন্ত মসজিদে যাওয়ার পথে।


~ হোসেন শাহের সমাধি,খাজাঞ্চিখানা, চাঁদ দরওজা ও নিম দরওজা

-----------------------------------------------------------------------

হোসেন শাহের মৃত্যু হয় ৯২৪ হিজরী অর্থাৎ ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে। বাইশগজী প্রাচীরের বাইরে বাংলোকোট নামক স্থানে বাংলার অন্যতম স্বাধীন সুলতান হোসেন শাহের সমাধি রয়েছে। সুলতান হোসেন শাহের সমাধির পাশে একই বেষ্টনীতে রাজ পরিবারের অন্যান্যদের সমাধিও রয়েছে। এর পার্শ্ববর্তী অংশ একসময় নীল ও সাদা মীনা করা টালি দ্বারা সজ্জিত ছিল। এর কাছাকাছি রয়েছে চাঁদ দরওয়াজা ও  নিম দরওজা। পাথর দ্বারা নির্মিত এই দুটি ফটক অনুভূতি স্থাপত্য কৌশল অপরূপতার অনবদ্য নিদর্শন ছিল। প্রাচীনকালে এই দুটি  ফটক ছাড়া গৌড়ের উত্তর দিকের ফটক দাখিল দরওয়াজা ও পূর্বেরটি শাহী দরওয়াজা নামে পরিচিত। দুর্গের দক্ষিনে ছিল রাজভবন। মধ্যবর্তী স্থানে ছিল চাঁদ দরওয়াজা। আর এই চাঁদ দরওয়াজা দিয়েই নগরের প্রাচীন ও নতুন অংশে প্রবেশ করা যেত।


এছাড়াও আরো প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে গৌড়ে। এদের মধ্যে গুমটী গেট, চিকা বা চামকান মসজিদ, শ্রী শ্রী গৌড়েশ্বরীর থান,কোতয়ালী দরওয়াজা, গুনমন্ত মসজিদ,ছোট সাগরদীঘিও অন্যতম। ঐতিহাসিক দিক থেকে এত সমৃদ্ধ গৌড়ের ইতিহাস যে এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকেও পর্যটকরা আসেন। ওপরে গৌড়ের বিশেষ বিশেষ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বর্ণনা দেয়া হল। আশাকরি পাঠকদের ভালো লাগবে।



ভ্রমণকাহিনী

চালসার ভিউ পয়েন্ট ও কোজাগরী চাঁদ

~ বিকাশ দাস



তখন চালসার খুব কাছাকাছি। বাসের জানলা দিয়ে (আপার চালসা) তাকিয়ে দেখলাম একটি মোহময়ী জল স্রোত কুলকুল করে সোজা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বয়ে চলছে। পশ্চিমের আকাশে লাস্যময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘা। খুব লোভ হলো এই জলে নেমেই জল খেলায় মত্ত হই। পরে জানলাম স্রোতস্বিনী জলধারাই কুর্তি। কুর্তি নদী। পাহাড়ী নদী। আপন গতিতে পাগলপারা।

নিজেদের লাগেজ রেখে, রিফ্রেশ হয়ে, হাল্কা কিছু খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তখন ঘড়ির কাঁটা ১ টা ছুঁয়েছে। হেমন্তের দুপুরও একদম খোশমেজাজে। ফুরফুরে। মোমের মতো রোদ্দুর যেন চাঁদর বিছিয়ে রেখেছে কুর্তির জলে। আমরা নেমে পড়লাম সেই জলে। তাপস অনিমেষ আমি ভেসে গেলাম শৈশবে। ঠান্ডা স্নিগ্ধ সে জলের ছোঁয়া। ঘন্টাখানেক কেটে গেল অবলীলায়। 


দুপুরে খাওয়ার পরে একটু রেস্ট। আমাদের মূল উদ্দেশ্য তো চালসার ভিউ পয়েন্ট। তাই সময় অপচয় করা মোটেই ঠিক নয়। অগত্যা নিজেদের তৈরী করা। 

পড়ন্ত বিকেল। আমি তাপস অনিমেষ চালসা স্টেশনের লাইন বরাবর হাঁটতে থাকলাম। মিনিট দশেক হাঁটার পরেই স্টেশন। স্টেশন থেকে খুব একটা বেশি দূরে নয় আপার চালসার পথ। এই হাঁটা পথটিই একদম শর্টকাট। খুব সহজেই উপরে ওঠা যায়। সিঁড়িগুলো ধাপে ধাপে সাজানো । দু 'পাশে জংলী পাহাড়ী ফুল। অগণিত লাল সাদা হলুদ ফুলগুলো ফুঁটে আছে থোড়ে থোড়ে। সিঁড়ি ডিঙিয়ে ওঠার পথে এক টুকরো দার্জিলিং এর অনুভূতি মনে হতেই পারে। ঈষৎ ঠান্ডা মৃদু বাতাসে শরীরে হালকা ঢেউ খেলে যাবে। অদ্ভুতভাবে শিহরিত হয়ে উঠবে শরীর।

কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই দেখা মিলবে চালসার সব থেকে উঁচু স্থান। ভিউ পয়েন্ট। তখনও আলো ছিল। আমরা তখন পি.ডব্লিউ.ডি সড়ক ধরে পাহাড়ী বাঁকের কাছে। এই বাঁক থেকেই সোজা সমতলের পথ। সম্মুখেই ভিউ পয়েন্ট । ভিউ পয়েন্টের কিছুটা আগে রেলিং আবৃত বাঁক থেকে দেখা যায় পুরো সমতলকে। দূরের কুর্তি নদীর উপর আবছায়া কুয়াশার মেলা। গাঢ় সবুজ পাতার উপর উপচে পড়ছে সারাদিন এর ক্লান্তির আকাশ। ক্রমে নীল হয়ে আসছে। লাল টুকটুকে সূর্যটি তখন পশ্চিম আকাশে। আলোর প্রতিফলনের ফলে গাঢ় কমলা রংয়ের পোশাকে উজ্জ্বল তখন চালসার আকাশ।


সন্ধ্যা। আমরা পৌঁছে গেলাম ভিউ পয়েন্ট। বসার জায়গাটি খুব সুন্দর। পরিষ্কার ও পরিপাটি করে সাজানো। আমাদের পৌঁছানোর আগে আরও অনেকেই উপভোগ করছিল তখন সন্ধ্যাকে। পুব আকাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে কোজাগরী চাঁদ। রূপালী থালার মতো। 


ইতিমধ্যে অর্ডার করা চা চলে এলো। চা এর চুমুকের সাথে সাথেই আমরাও ক্রমে চমকিত হচ্ছিলাম চালসা ও তার অপার নৈসর্গিক দৃশ্যের কাছে। তাপস গলা খুলে গান ধরে- 


'' এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়

একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু'

আমরা গানের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে চলছি। জড়িয়ে পড়ছি মায়ায়। আমাদের অজান্তেই কখন যে চাঁদটিও ঠিক মাথার উপরে চলে এলো। ঠান্ডা ভুলে গেলাম। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই রইলাম কুর্তি পাড়ের চালসার আকাশের দিকে। অনন্য অনুভূতি ও অসাধরণ যাপন। 


পথ নির্দেশ: এন জি পি স্টেশন থেকে বাসে কিংবা ট্রেনে অনায়াসে চালসা আসা যায়। আপার চালসার রেস্টুরেন্ট ,লজগুলো অপেক্ষায় বহিরাগতদের স্বাগতম জানানোর জন্য। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রিসর্ট: হেভেন ভিউ রিসর্ট , রিসর্ট তরাই-ডুয়ার্স, সবুজের কোলে, সন্ধ্যা লজ ,হোটেল ভিশাল ইত্যাদি। বাস স্ট্যান্ড এলাকার যেকোন টোটোওয়ালা, রিক্সাওয়ালাকে বললেই ওরাই পৌঁছে দেবে উপরিক্ত ঠিকানায়।



ভ্রমণকাহিনী

বনবস্তিতে একরাত

~ সত্যম ভট্টাচার্য



বছর শেষ হতে চলছিল।যদিও যখন শীত পড়ছিল, ভেবে রেখেছিলাম এবার বড়দিনের ছুটিতে বেশ কদিনের জন্য একটা কোথাও ঘুরতে যাব।কিন্তু সে ছুটিরও যখন বেশ কটা দিন পেরিয়ে গেল, মনে হল অন্তত একটি রাত বাইরে না কাটালে নতুন বছর শুরু করব কিভাবে?

ভাবতে ভাবতেই মনে হল শহরের অনুজ লেখক রঙ্গন কদিন আগে বলেছিল ওর এক বন্ধু থাকে জলদাপাড়া সংলগ্ন বনবস্তিতে।সে যাওয়ার নেমতন্ন করে রেখেছে যে কোন সময়।ভাবলাম সেখান থেকে একটু ঘুরে আসলে মন্দ হয় না।অনেক রাতে রঙ্গনকে যখন বললাম ও বলল কথা বলে জানাচ্ছে।উত্তর আসলো খানিক পরেই। অবশ্যই যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু পরদিন হবে না।রঙ্গনের কাজ আছে।হতে পারে তারপর দিন।ঠিক হ্যায়,কোই বাত নেহি।

তিরিশে ডিসেম্বর সকাল বেলা আমার দু চাকার যানে আমরা শহর ছাড়লাম। চায়ের দোকানগুলো থেকে তখন উনুনে আঁচ দেওয়ার ধোঁয়া উড়তে শুরু করেছে। পেপার ওয়ালারা রাস্তার ধারে বসে তাদের পেপার গুছিয়ে নিচ্ছে।মূল রাস্তা এখন প্রশস্ত চার লেন। পাহাড়পুরের সকালের সবজির হাটের পাশ কাটিয়ে তিস্তা নদীর কাছাকাছি পৌঁছে দেখি ধুলোর কারণে নদী ঢেকে আছে গাঢ় কুয়াশার স্তরে।নতুন ব্রীজ দিয়ে তিস্তার পর দোমহনী মোর এখন একদম অন্যরকম। ফ্লাইওভার হয়ে গিয়ে পুরনো দোমহনী মোড়কে প্রায় চেনাই যায়না।

চলতে চলতে ময়নাগুড়ি রোড, তারপর ময়নাগুড়ি বাইপাস ধরে আমরা এগোতে লাগলাম। কিন্তু নিজেদের বাহন থাকবে আর ইচ্ছেমতো দাঁড়াবো না তা কি হতে পারে?

অতএব ময়নাগুড়ি পেরিয়ে ঝাঝাঙ্গি ধাবাতে দাঁড়াতেই হল। যারা জানেন তারা তো জানেনই, কিন্তু যারা জানেন না তাদের জন্য বলছি। ডুয়ার্সের এ চত্বরে এলে অবশ্যই এই ধাবার লাড্ডু এবং প্যাড়ার স্বাদ নিতে ভুলবেন না। সাথে রুটি তড়কা আর চা তো থাকছেই।

শীতের সকালের নরম রোদে পিঠ দিয়ে ধোঁয়া ওঠা রুটি তড়কা পেঁয়াজ লঙ্কা সহযোগে চা আমাদের গা গরম করে দিলো। শরীরে ঠান্ডার জন্য যে একটা আড়ষ্ট ভাব হয়েছিল দেখলাম তা একদম উধাও হয়ে গেছে। ফোর লেন রাস্তা হবার কারণে ঝাঝাঙ্গি ধাবার সামনের দাঁড়ানো ট্রাকের সারি এখন আর নেই।

এবারে আবার চলার শুরু। জলঢাকা নদী, ডাউকিমারী পেরিয়ে ডুয়ার্সের সবজি- বিশেষত আলুর জন্য বিখ্যাত ধুপগুড়িকে এখন চেনাই যায় না। শহরের মূল কেন্দ্র থেকে যে গাছটি দাঁড়িয়ে একদিকে গয়েরকাটা বীরপাড়া এবং অন্যদিকে পেরিয়ে শালবাড়ি পেরিয়ে ফালাকাটার দিকে আঙ্গুল দেখাতো, সে আর নেই। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে তাকে খুঁজতে যেতেই কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের তিরস্কার শুনলাম। অবশেষে যখন সে দিক থেকে ঘুরে গেলাম ফালাকাটার দিকে, মনে হল সে বেচারা আর কিভাবে জানবে আমাদের কত স্মৃতি সে গাছকে নিয়ে।

দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ফালাকাটায়। কোথাও ঘুরতে বের হলে আমার উদ্দেশ্য থাকে সকাল সকাল সেই জায়গায় পৌঁছে যাওয়া। তাহলে যেখানে যাচ্ছি সেই জায়গাটিকে দেখবার অনেক সময় পাওয়া যায়। তাই দশটার আগেই ফালাকাটায় পৌঁছে গেলেও একটি বিশেষ কারণে আমাদের সেখানে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতেই হল।

অতঃপর ফালাকাটা থেকে মাদারিহাটের রাস্তায় চলা। যারা গেছেন এই রাস্তাটি ধরে তারা জানেন এই রাস্তাটির স্টপেজের নাম গুলি ফালাকাটা থেকে তাদের দূরত্ব অনুসারে। যেমন- তিনমাইল, পাঁচমাইল, সাতমাইল ইত্যাদি। আমাদের গন্তব্য ছিল নয় মাইল।

অতঃপর সেখানে পৌঁছে মূল রাস্তা ছাড়লাম। ডুয়ার্সের শস্য-শ্যামলা সবুজে ঢাকা গ্রামের পথ দিয়ে এবারে আমরা পৌঁছলাম রঙ্গনের বন্ধুর বাড়ি। বন্ধুটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিক্ষিত যুবক। বর্তমানে সে ফালাকাটা কলেজে ভূগোল স্নাতকের ছাত্র। দাদা বাইরে কাজ করতে চলে যাবার কারণে এখন গোটা পরিবারের ভারই তার ওপরে। তাও সমস্ত কাজ সামলে সে আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল।

সামান্য বিশ্রাম নিতে নিতেই আমাদের আলাপ জমে উঠলো। 

বন্ধুর বৌদির হাতে বানানো গরুর দুধের অসামান্য চা আর টিফিন খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। এবারে আমাদের সঙ্গী হল সে গ্রামেরই আরেক যুবক। সে ডুয়ার্সের ভূমিপুত্র। স্নাতক ছেলেটি জীবিকার কারণে বিদ্যুতের কাজ করলেও আসলে সে সেই গ্রামের শিক্ষক। পড়ানো ছাড়াও সে কবিতা লেখে, বাচ্চাদের দিয়ে নাটক করায়, ঘুরতে বা অনুষ্ঠান করতে নিয়ে যায় বাইরে। বাড়ির উঠোনে বসে কিছুক্ষন তাঁর কবিতা শুনে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম বনবস্তি ঘুরতে ।

ডুয়ার্সে ঘুরে বেড়ালে শুধু কানে বেজে ওঠে ছোটবেলায় পড়া রচনার সেই কথাটা। আমাদের দেশ বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যর দেশ। আর গোটা ডুয়ার্স এভাবেই যেন তার সমস্ত জনজাতিকে আগলে রেখেছে। এখানে একই সাথে পাশাপাশি বাস করে আদিবাসী, রাজবংশী, নেপালি, রাভা, মেচ সকলে। বনবস্তিতেও সেরকমই দেখলাম।

আর অদ্ভুতভাবে বেঁচে থাকে এই জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন বন বস্তির বাসিন্দারা। একদিকে যেমন হাতি গন্ডার বাইসানের আতঙ্কে তাদের রাতের পর রাত বিনিদ্র কাটে, আবার জাতীয় উদ্যানের নিয়ম অনুসারে সংলগ্ন মফস্বলে হাট বাজার করতে যেতে হলেও তাদের বনদপ্তর এর অনুমতি নিয়েই যেতে হয়।

বনবস্তিতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কখন যে দুপুর পেরিয়ে বিকেল আর বিকেল পেরিয়ে বেলা সন্ধ্যার দিকে গড়াচ্ছিল তার কোন খেয়ালই ছিলো না আমাদের। অবশেষে যখন সময়ের দিকে নজর পড়লো রোদ তখন ঢলে পড়েছে। বিকেলের হলুদ রোদের মধ্য দিয়ে জলদাপাড়ার বনবস্তির লম্বা লম্বা গাছগুলির ছায়া হয়ে উঠতে শুরু করেছে দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘতর। শিরশিরানি ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। তার মধ্যে দিয়েই আমরা রঙ্গনের বন্ধুর বাড়ির বারান্দায় বসে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিলাম। ওদিকে সন্ধে নামার সাথে সাথে ময়ূরের ডাক আরো তীব্র হতে শুরু করেছে। একই সাথে কানে আসছে নাইটজারের ডাক।

শহর থেকে দূরে এই রকম একটি রাত অনেকদিন পর। দূরে দূরে টিমটিমে ইলেকট্রিকের আলো জ্বলছে বাড়িতে বাড়িতে। মাঝে মাঝে নিকষ কালো অন্ধকার। এরকমই এক অদ্ভুত আলো-আঁধারি পরিবেশে এবারে আমরা হাঁটতে হাঁটতে চললাম গ্রামের স্কুলের মাঠের দিকে। শয়ে শয়ে জোনাকি সে মাঠে আলো ছড়াচ্ছে। পূর্ণিমা মনে হয় আর বেশি দেরি নেই। চাঁদের আলোয় বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারিদিক। 

ফেরার পথে আমরা ইচ্ছে করেই রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়লাম চা বাগানের ভেতর।এরপর যেন শুরু হল এক স্বপ্নের জগত।চাঁদের আলোয় চা বাগানের উঁচু-নিচু জমির ভেতর দিয়ে চলতে চলতে যেন প্রতি মুহূর্তে চারিদিকে সৃষ্টি হতে লাগল জ্যোৎস্নামাখা এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশের। কুয়াশার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম এক নাম না জানা ছোট্ট নদীর পারে। তার বুকে তখন চাঁদের ছায়া পড়েছে। দূর থেকে ভেসে আসছে জঙ্গলের নাম না জানা পাখিদের ডাক।

এরপর ফিরে এসে রাতের খাবারে অসাধারণ মাংস রুটি খেয়ে ঢুকে পড়লাম বিছানায় গরম লেপের ভেতর।

পরদিন সকালে বন্ধুর বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চললাম মাদারিহাটের দিকে। এবারের লক্ষ্য মাদারিহাট এর বিখ্যাত কমলাভোগ মিষ্টি। দুটি দোকানে সেই মিষ্টির স্বাদ নিতেই কথা বললাম পঈযটক আসা নিয়ে।কারণ এটা ডুয়ার্স বা জলদাপাড়ার তুঙ্গ সময়।কিন্তু সবার মুখেই এককথা-লোক নেই দাদা।

যাইহোক মাদারীহাট থেকে বেরিয়ে চললাম রাঙালিবাজনায় কবি ওয়াহিদার হোসেনের বাড়িতে। ওয়াইদার রাস্তাতেই অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য।বহুদিন আগে একবার ওর বাড়ি গিয়েছিলাম।সে বাড়ি এখন অন্যরকম।ওর এখন ঘরনী হয়েছে-সাহানা।সেখানে আবার চা মিষ্টি খেতে খেতে আরেক প্রস্থ আড্ডা হল। মনে পড়ল আজ বর্ষশেষের রাত। তাই বেশি সময় আর কাটানো গেল না। ফেরার পথ ধরলাম।আর রাস্তায় বের হলে যা হয়। যে পথে গিয়েছিলাম সে পথে আর ফিরি না।তেলিপাড়া মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরে ধরে নিলাম বিন্নাগুড়ি বানারহাট এর রাস্তা।

ডুয়ার্সের সরলবর্গীয় অরণ্যের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে এসে দাড়ালাম ডায়না নদীর উপর। করোনার কারণে এবারের পিকনিক কম। দূরে ভুটান পাহাড়।তিরতির করে নীল জল বয়ে চলেছে শীতের শীর্ণকায় নদীগুলি দিয়ে। সেখানে আবার আরেক প্রস্থ চা খেয়ে জলঢাকা পেরিয়ে মূর্তি নদী। তখন দুপুর পেরিয়ে বিকেল। আর বেশিক্ষণ সময় কাটানো গেল না। লাটাগুড়ি পেরিয়ে এক চক্কর ডুয়ার্স ভ্রমণ শেষ করে বাড়ির পথ ধরলাম।


সংগীত বিষয়ক

সংগীতের এক আলোকময় প্রকাশ

 ~ অজন্তা সিনহা



দাদু দ্বারকানাথ ঘোষ ছিলেন ইতিহাস প্রসিদ্ধ ডোয়ার্কিন হারমনিয়ামের জনক। তাই হারমনিয়ামের সঙ্গে তাঁর যে নাড়ির টান রচিত হবে জন্মকালেই, তাতে আর আশ্চর্য কি? পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ আর হারমনিয়াম যে একে অপরের পরিপূরক ছিলেন, একথা বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। শুধু হারমনিয়াম নয়, তবলাশিল্পী রূপেও তিনি ছিলেন কিংবদন্তী। আদতে তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, সংগীত এবং সংগীত দুনিয়ার বাইরেও। সেসব বিস্তারে পরে যাব। তার আগে আরও কিছু তথ্য। 

ডোয়ার্কিন-এর যাত্রা শুরু ১৮৭৫, আর গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের জন্ম ১৯০৯। সাংগীতিক ইতিহাসের পাতায় মাঝের দশকগুলি যেন এক প্রতিভার আবির্ভাবের প্রস্তাবনা। ১৯০৯’এর ৮ই মে। ফারুখাবাদ ঘরানার শাস্ত্রীয় সংগীতে বিশেষজ্ঞ অতি গুণী এই মানুষটির জন্ম হলো আদ্যন্ত এক সাংগীতিক পরিবারে। বাড়ির পরিবেশে গানবাজনা। সংগীত জগতের প্রথিতযশা মানুষজনের নিত্য আনাগোনা তাঁদের কলকাতার বাড়িতে। সেই পরিবেশ এবং উত্তরাধিকার, সব মিলিয়ে শৈশব-কৈশোরেই যে মেতে উঠবেন তিনি কথা-সুর-তালের উৎসবে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। 

মজার ব্যাপার হলো, গান তাঁর সহজাত। কিন্তু শখের মানচিত্র? সে যে আরও নানা রঙে বাহারি।

শৈশব থেকেই গানের পাশাপাশি খেলাধুলাতেও প্রবল আগ্রহ ছিল জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের। খেলতেন ফুটবল, হকি, পোলো ও বিলিয়ার্ড। অনুরাগ ছিল পেন্টিংয়েও। যদিও সেই শখ তিনি বজায় রাখতে পারেননি। ফুটবল খেলতে গিয়ে চোখে আঘাত লাগে। তারপরই ছেড়ে দিতে হয় পেন্টিংয়ের অভ্যাস। যেন এও এক দিকনির্দেশ! হারমনিয়ামের সুরে, তবলার বোলে অবিরত অপরূপ ছবি আঁকবেন তিনি। মুগ্ধ করবেন কয়েকটি দশক ধরে, এটাই নিশ্চয়ই নিয়তি নির্ধারিত ছিল। 


যাই হোক, এরপরই পুরোমাত্রায় সংগীতে মনোনিবেশ করেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। গিরিজা শঙ্কর, মহম্মদ সাগির খান ও মহম্মদ দবির খানের কাছে শুরু হলো কন্ঠসংগীতের তালিম। পাশাপাশি তবলার তালিম চললো ফারুখাবাদ ঘরানার উস্তাদ মসিত খানের কাছে। পরবর্তীতে পাঞ্জাব ঘরানার উস্তাদ ফিরোজ খানের কাছেও তবলার তালিম নেন তিনি। তাঁর বাদনে অনুপম শিল্প সৌকর্যের পাশাপাশি বৈচিত্রের স্বাদ মেলে এইজন্যই। সেই নান্দনিক স্বাতন্ত্র, বৈশিষ্ট্য ও অভিব্যক্তি অনুভূত হয় পন্ডিতজির উত্তরসূরী কানাই দত্ত, শ্যামল বোস, শঙ্কর ঘোষ, অনিন্দ্য চ্যাটার্জি, অভিজিৎ ব্যানার্জি, নিখিল ঘোষ, রাজকুমার মিশ্র প্রমুখ ছাত্রের মধ্যেও। অন্যদিকে প্রসূন ব্যানার্জি, অরুণ ভাদুরি, অজয় চক্রবর্তীর মতো সংগীতশিল্পী তাঁর তত্ত্বাবধানে তালিম নিয়েছেন। সেখানেও মেলে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বর্ণময় প্রভাব। পরবর্তীতে তাঁর প্রত্যেক ছাত্রই স্ববৈশিষ্টে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। 

গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ছিলেন আদ্যন্ত একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার কথা আগেই বলেছি। তার সঙ্গে মিলেছিল গুরুজীর অপার সৃষ্টির ক্ষুধা। মনেপ্রাণে উদার ও আধুনিক ছিলেন। নতুনকে বরণ করতে দ্বিধা করেননি কখনও। বিচিত্রমুখী ছিল তাঁর কর্মপ্রবাহ। আকাশবাণীর সঙ্গে দীর্ঘ পনের বছর প্রযোজক রূপে যুক্ত থাকাকালীন কত যে কাজ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। নানা ধরনের গান লিখেছেন। শাস্ত্রীয়, লাইট মিউজিক, আধুনিক ছাড়াও লিখেছেন অর্কেস্ট্রা, কোরাল ও পারকাসন স্টাইলে। শাস্ত্রীয় সংগীতের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ‘সৌরভ একাডেমি অফ মিউজিক’ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন সংগীত রিসার্চ একাডেমির সঙ্গেও।


সেই সময়ের বহু খ্যাতনামা শিল্পীর গাওয়া জনপ্রিয় গানের রেকর্ডের কম্পোজিশন এবং সংগীত পরিচালনা করেন তিনি। সেটা গ্রামোফোন রেকর্ডের কাল। বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। এক একজন দিকপাল শিল্পী। আলো করে ছিলেন তাঁরা বাংলা সংগীত ও সাংস্কৃতিক দুনিয়া। পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ যে সেই আলোকবর্তিকার অনেকটা জুড়ে ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর সৃষ্ট ‘দ্য ড্রামস অফ ইন্ডিয়া’ ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। পারকাসন নিয়ে এজাতীয় বড় মাপের কাজ সেই প্রথম। এছাড়াও পন্ডিত ভি জি যোগের সঙ্গে পন্ডিতজির ‘যুগলবন্দী’ ভারতীয় সংগীতের জগতে এক অমর সৃষ্টি। পন্ডিত ভি জি যোগ বেহালায় আর হারমনিয়ামে পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। সংগীতের মর্যাদা, ঐতিহ্য ও বিশুদ্ধতা বজায় রেখেও যে পরীক্ষামূলক কাজ করা যায়, এগুলি হলো তার উৎকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত। চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে তবলা, পাখোয়াজ, কথক ও তাড়ানার সংমিশ্রনে গুরুজীর তৈরি ‘চতুরঙ্গ’ ! এর নান্দনিক প্রকাশ তুলনাহীন। বলা বাহুল্য, এই প্রত্যেকটি কাজই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্বীকৃত ও উচ্চ প্রশংসিত। 

বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। তার মধ্যে ‘যদুভট্ট’র খ্যাতি ঐতিহাসিক। এছাড়াও তালিকায় রয়েছে ‘আঁধারে আলো’, ‘রাজলক্ষী ও শ্রীকান্ত’র মতো ছবি। ওঁর আর একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ‘বিড গেম’। ইশু প্যাটেল নির্মিত এই এনিমেটেড শর্ট ফিল্ম তৈরি হয় ১৯৭৭ সালে। ৫ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত এই ছবির সংগীত পরিচালনা করেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। এখানেও অননুকরণীয় তিনি।


সময়ের সাথে সাথে কলকাতার বউবাজার অঞ্চলস্থিত তাঁর বাড়ি হয়ে উঠেছিল সংগীতের পীঠস্থান। কলকাতার তো বটেই, সমগ্র দেশ বা বিশ্ব, শহরে আগত সংগীত দুনিয়ার রথী মহারথীগণ গুরুজীর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন নিয়মিত ও একাধিকবার। তাঁরা আসবেন আর সংগীতের আসর বসবে না? সেই আসরগুলিও যে এক একটি ইতিহাস রচনাকারী, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৫৪ সালে পন্ডিত বড়ে গোলাম আলি খাঁ গেয়েছিলেন রাগ ছায়ানট এমনই এক আসরে, যা এককথায় অবিস্মরণীয়। তৎকালীন সাংগীতিক ইতিহাস লেখকদের কলমে সোনার অক্ষরে লেখা আছে সেই অভিজ্ঞতার কাহিনী। 


কিংবদন্তী ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই মানুষটির ঝুলি যে নানা পুরস্কারে ভরে উঠবে, সে তো স্বাভাবিক! তার মধ্যে অবশ্যই বলার ১৯৭৪ সালে প্রাপ্ত ‘সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার’। ১৯৮৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করে। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাজ ও জীবনযাপন এমন এক সময়ে, যখন সেভাবে সংবাদ মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত ছিল না। যতটুকু যা, খবরের জন্য। সংবাদ মাধ্যম তখনও নির্লজ্জ প্রচারযন্ত্র হয়ে ওঠেনি। তা সত্ত্বেও ওঁদের মতো গুণীজন ইতিহাসে জায়গা করে নেন নিজেদের অপার প্রতিভা, মেধা ও সৃজনের সম্ভারে। তাঁর সৃষ্ট বিরলধর্মী কাজে ও পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যাওয়া সাংগীতিক পরম্পরায়। ১৯৯৭’এর ১৮ ফেব্রুয়ারি মারা যান গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, একটি সংগীতমুখর অপরূপ যুগের অবসান ঘটিয়ে। 



সংগীত বিষয়ক

অজয় ভট্টাচার্য


~ শুভশ্রী ভট্টাচার্য 

‘রাজার কুমার পক্ষীরাজে দেশ বিদেশে ঘুরে এসে 

তেপান্তরে বটের ছায়ায় ক্লান্ত হয়ে বসল শেষে,

সূয্যি তখন পাটে নামে’ --- 

বাড়িতে সর্বক্ষণ এসব গান শুনেছি ছোটবেলা থেকে। আমার ঠাকুরদা সত্যজীবন ভট্টাচার্য কুমিল্লায় বড় হওয়ার ফলে এইসব গান শুনে শুনেই বড় হয়েছেন। তাঁর ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা ছিল কথা ও সুর সহ গান মনে রাখার। উদাত্ত কন্ঠে তিনি গাইতেন এইসব গান। দিদিমা প্রীতি রায়ও তাঁর মাস্টার মশাইয়ের কাছে বা রেকর্ড শুনে অনেক পুরনো গান তুলেছিলেন। জলসাতেই হোক বা রান্নাঘরে লুচি ভাজতে ভাজতেই হোক, এই সব গান আমাদের কানে ঢেলে দিয়েছেন আজীবন। পরিচয় করিয়েছেন আধুনিক বাংলা গানের বিরাট ঐশ্বর্যের সঙ্গে। তখনও জানতাম না, এসবের রচয়িতা কে, বা আদৌ এই গানগুলি কেউ লেখে। তখন শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনেছি আর চুপটি করে ভেবেছি—

‘স্বপন দেখি প্রবাল দ্বীপে তুলব আমি বাড়ি

সাগর থেকে ঝিনুক এনে বাঁধব সোপান তারই

আমার তিনমহলা বাড়ি’। 

পরে জেনেছি গীতিকারের নাম অজয় কুমার ভট্টাচার্য। 

বাংলা সঙ্গীত জগতের রবীন্দ্রোত্তর গীতিকারদের কথা আমরা যদি ভাবতে বসি তাহলে প্রথমেই যাঁর নাম মনে আসবে তিনি হলেন এই অজয় ভট্টাচার্য। বললাম বটে রবীন্দ্র-পরবর্তী, কিন্তু সময়ের নিরিখে দেখলে বলতে হয় তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন। যার মধ্যে শেষ বছর পনের ধরে অবিরাম তিনি গান লিখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের লোকান্তর ঘটে ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দে। অর্থাৎ বলা যায় অজয়বাবু রবীন্দ্র যুগে বসেই তিনি নিজের মতো করে গান লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য যে খুঁজলে পাওয়া যাবে না এমন নয়। তবু তাঁর গানে একটি স্বকীয় ঘরানা খুঁজে পাওয়া যাবে যা এই দুই যুগপুরুষের থেকে আলাদা। ভাবের দিক থেকে নূতন না পুরাতন সে বিচারের স্পর্ধা করছি না, তবে অন্য রকম। অনেকটা রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের কবি জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তীর মতো। তবে তিনি কবি নন। গীতিকার। আর বলা যেতে পারে আধুনিক গানের প্রথম গীতিকার। কারণ তাঁর আগে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ—এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন একাধারে গীতিকার এবং সুরকার। অজয় ভট্টাচার্যই প্রথম গীতিকার, যাঁর গানে অন্যান্য সুরকারেরা সুর দিয়ে গান রচনা করেছেন। একটি গান তৈরি হতে যে একাধিক ব্যক্তির সম্মিলিত প্রয়াস, তার সূচনাও তাঁদের সময়েই হয়। সংখ্যার বিচারে দেখতে গেলেও নজরুল আর রবীন্দ্রনাথের পরেই আসে তাঁর নাম। নজরুলের প্রায় সাড়ে তিন হাজার গান আছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংখ্যা বাইশশো মতো। সেখানে মাত্র পনের বছরে অজয় ভট্টাচার্যের গানের সংখ্যা দুই হাজারের মতো (মতান্তরে দেড় হাজার)। 

কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এর মধ্যে বেশির ভাগ গানই আর পাওয়া যায় না। পুরনো রেকর্ড যাঁরা সংগ্রহ করেন তাঁদের দৌলতে কিছু গান আমরা আজও শুনতে পাই। কিন্তু বহু গান বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। তাঁর জীবৎকালে ‘আজি আমারই কথা’, ‘মিলন-বিরহ গীতি’, ‘শুক-সারী’ –এই তিনটি গানের সংকলন প্রকাশিত হয়। মৃত্যুর পর ‘আজও ওঠে চাঁদ’, স্ত্রী রেণুকা ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ‘অজয় ভট্টাচার্যের গান’, শচীন দেববর্মনের সম্পাদনায় স্বরলিপি সহ গানের সংকলন ‘সুরের লিখন’ প্রকাশ পায়। সংকলনগুলি তাঁর স্ত্রী রেণুকা ভট্টাচার্যের সৌজন্যে ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর ডিজিট্যাল সাউথ এশিয়া লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। সেখানে তাঁর স্বহস্তে লেখা পাণ্ডুলিপিও আছে। 

আরেকজন ক্ষণজন্মা সুরকারের সুর দিয়েই তাঁর গানের জগতে আত্মপ্রকাশ। সুরসাগর হিমাংশু দত্ত। তিনিও কুমিল্লার মানুষ। তিনিও ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে ১৯৪৪ খ্রীষ্টাব্দে পরপারে চলে যান। কিন্তু তার মধ্যেই বাংলা গানের জগতে বিরাট বিপ্লব করে যান। বেশির ভাগ তাঁর বন্ধু সুবোধ পুরকায়স্থের কথায় সুর করে গেলেও অজয় ভট্টাচার্যের কথাতেই তাঁরও প্রথম আত্মপ্রকাশ এই একই গানে। তৎকালীন চিত্র পরিচালক পশুপতি চট্টোপাধ্যায় একদিন তাঁর বন্ধু অজয় ভট্টাচার্যকে ডেকে বললেন, নজরুল একটা চমৎকার গান লিখেছে—কাল রেকর্ডে শুনলুম। ‘হাস্নুহানা আজ নিরালায়’। শুনে মুচকি হেসে অজয়বাবু বললেন, গানখানা নজরুলের লেখা নয়। পশুপতিবাবু বললেন, বল কী! তাহলে এমন লেখা লিখলে কে? অজয়বাবু বললেন, আমি হে আমি। 


নজরুলের প্রচ্ছন্ন ছাপ গানটির ছত্রে ছত্রে মিশে থাকলেও ক্রমশ তিনি স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দেন। আসলে সে যুগে বসে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের দ্বারা প্রভাবিত না হওয়াটাই অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। পরে হিমাংশু দত্ত তাঁর বহু গানে সুর করেন। তার মধ্যে ‘ঝর ঝর ধারা বিরহ বরিষা’, ‘বিদায়ের শেষ বাণী’, ‘বরষার মেঘ নামে’, ‘ছিল চাঁদ মেঘেরও পারে’, ‘আলো ছায়া দোলা উতলা ফাগুনে’, ‘আলোক আঁধার যেথা করে খেলা’, ‘আজি আমারই কথা ওগো বিমনা সাঁঝে’, ‘ঝরা চামেলি বনে কেন আসিলে তুমি’, ‘মম মন্দিরে এলে কে তুমি’, ‘ফাগুনের সমীরণ সনে’—আরো অসংখ্য গান। এগুলি সে সময় লোকের মুখে মুখে ফিরত। এর মধ্যে কিছু গান পরে সুমন চট্টোপাধ্যায় পুনরায় গেয়ে একালের শ্রোতাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনেন। কিছু গান অযত্নে অবহেলায় হারিয়ে যায়। 

আমার ঠাকুর্দার কাছে শুনেছি সেই সময় কুমিল্লা ছিল সঙ্গীতের একটি পীঠস্থান। কত গুণী শিল্পীর যে জন্ম দিয়েছে এই শহর তার ইয়ত্তা নেই। বলা যেতে পারে রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী যে ত্রয়ী বাংলা গানের তরণীকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা সকলেই কুমিল্লার ভূমিপুত্র। এই ত্রয়ী হলেন—অজয় ভট্টাচার্য, হিমাংশু দত্ত এবং শচীন দেব বর্মণ। একজন গীতিকার, একজন সুরকার এবং একজন সুরকার তথা গায়ক। এই তিনজনের মিলিত ফসল আধুনিক বাংলা গানের সুবর্ণযুগের গোড়াপত্তন। শচীনদেব বর্মণ ছিলেন অজয় ভট্টাচার্যের বাল্যবন্ধু। কুমিল্লা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্ট—এই জায়গাগুলি সবই তখন ছিল ত্রিপুরা সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। সেই ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান হয়ে শচীন দেব বর্মণ প্রাসাদ ছেড়ে, বিলাস বৈভব ত্যাগ করে কোলকাতায় চলে আসেন শুধুমাত্র সঙ্গীতকে পাথেয় করে পথ চলবার জন্য। মীরা দেব বর্মণের সঙ্গে তাঁর প্রেম ঘটে তাঁদের সঙ্গীতগুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে একত্রে গান শেখার সময়। কিন্তু এই প্রেমের ঘটনাকে গুরু ভীষ্মদেব ভাল মনে মেনে না নেওয়ায় তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। পরে অবশ্য মীরাকে বিয়ে করেছিলেন শচীন দেব বর্মণ। যাই হোক, শচীন কত্তা কোলকাতায় যাওয়ার সময় তাঁর বন্ধু অজয় ভট্টাচার্যকেও সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন কোলকাতায়। তার আগে অজয় বাবু কিছুদিন কুমিল্লা কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন ত্রিপুরার রাজপরিবারের ছেলেদের পড়িয়েছেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু সেসব ছেড়ে তিনি কোলকাতায় এসে বালিগঞ্জ তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতার চাকরি নেন। তাঁর লেখা বহু গানে বন্ধু শচীন দেব বর্মণ সুরারোপ করে গেয়ে রেকর্ড করেন। কিছু গানের উল্লেখ না করলেই নয়। ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে’, ‘আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে’, ‘স্বপন দেখেছে গিরিরানী’, ‘কণ্ঠে তোমার দুলবে বলে’, ‘ওরে সুজন নাইয়া’, ‘প্রেম যমুনারই তীরে’, ‘ওগো ঝন ঝন ঝন ঝন মঞ্জীর বাজে’, ‘স্বপন না ভাঙে যদি শিয়রে জাগিয়া রব’, ‘মঞ্জুরাতে আজি তন্দ্রা কেন হে প্রিয়’, ‘এই মহুয়াবনে মনের হরিণ হারিয়ে গেছে’—এরকম আরো হাজারো গান। কিছু রয়ে গেছে আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায়, বেশির ভাগই হারিয়ে গেছে যথোচিত সংরক্ষণের অভাবে।


শচীন দেব বর্মণের গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ও কণ্ঠে চারটি গান খুবই বিখ্যাত হয়েছিল। --‘ফুলেরই দিন হল যে অবসান’, ‘শেষের গানটি ছিল তোমারই লাগি’, ‘জাগো আলোকলগনে’, ‘যদি মনে পড়ে সেদিনের কথা’। চারটিই রাগাশ্রয়ী। এই সব গান সেই সময় সারা বাংলার জন সাধারণের মুখে মুখে ঘুরত। 

শচীন দেব বর্মণ, হিমাংশু দত্ত ছাড়াও তাঁর গানে সুর দিয়েছিলেন অনেক বড় বড় সুরকার। পঙ্কজ মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, অনুপম ঘটক, তিমিরবরণ, শৈলেশ দত্তগুপ্ত প্রমুখ। তাঁর গানে কণ্ঠ দান করেছিলেন তাবড় তাবড় শিল্পী। তার মধ্যে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, শচীন দেব বর্মণ ছাড়া সায়গল, কানন দেবী, শৈল দেবী, পঙ্কজ মল্লিক, বীণা চৌধুরী, দ্বিজেন চৌধুরী, কমলা ঝরিয়া, গীতা দাস, আরতি দাস, প্রতিভা সেন, এমনকি হেমন্ত মুখোপাধ্যা্‌য়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্রও তাঁর রচিত গান গেয়েছেন। 

নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর খুবই অন্তরঙ্গ পরিচয় ছিল। তাঁর প্রথম কবিতা ‘উল্কা’ প্রকাশিত হয় নজরুলেরই ‘ধূমকেতু’ নামক পত্রিকায়। নজরুল কুমিল্লায় এলে তালপুকুর সংলগ্ন অঞ্চলেই থাকতেন, যে পুকুর নিয়ে তাঁর বিখ্যাত ছড়া আছে—‘বাবুদের তালপুকুরে হাবুদের ডালকুকুরে’। কুমিল্লা শহরের দক্ষিণে চর্থা এলাকার এই তালপুকুরের এক ধারেই ছিল শচীন দেব বর্মণের বাবা নবদ্বীপ চন্দ্রের বাড়ি। অজয় ভট্টাচার্যের বাবা রাজকুমার ভট্টাচার্য ছিলেন কুমিল্লা শহরের নামজাদা উকিল। ফলে তাঁর জন্ম শ্যামগ্রামে হলেও বেড়ে ওঠা এই কুমিল্লা শহরের সাঙ্গীতিক পরিবেশের মধ্যেই। কানাকেষ্ট ওরফে কৃষ্ণ চন্দ্র দে, ওস্তাদ আফতাবউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, ভীষ্মদেব, ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ প্রমুখের কালোয়াতি গান তখন কুমিল্লার আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াত। এই প্রেক্ষাপট থেকে যে এই রকম কালজয়ী গীতিকার, সুরকার, গায়ক উঠে আসবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। 


তবে তাঁর লেখা সব গান থেকে যে রাগপ্রধান গানই সৃষ্ট হয়েছে তা নয়। ভজন, গজল ছাড়াও গ্রাম বাংলার বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, আগমনী গানও পাওয়া যায় অনেক। তাঁর প্রথম দিকের গানগুলি মূলত রোম্যাণ্টিক ধরণের হলেও পরের দিকে তাঁর গানে সমাজতন্ত্রের অবধারিত ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। লেনিন সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ গড়ে ওঠে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন তাঁর লেখায় ফুটে উঠতে শুরু করে। 

‘একটি পয়সা দাও গো বাবু’ – ‘শাপমুক্তি’ সিনেমার এই গানটি অনুপম ঘটকের সুরে প্রতিভা সেনের কণ্ঠে খুব বিখ্যাত হয়েছিল। তবে প্রেমের বিশেষত বিরহের গানে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কাব্যগীতি আর ভক্তিগীতির মধ্যে তুলনা করতে বসলে কাব্যগীতিকেই এগিয়ে রাখতে হয়।

স্বল্প দৈর্ঘ্যের জীবনে কত কী-ই না করেছেন অজয় ভট্টাচার্য। বাংলার অধ্যাপনা এবং গান লেখা ছাড়াও লিখেছেন একটি উপন্যাস ‘যেথা নাই প্রেম’।

জার্মান লেখক এরিখ মারিয়া রেমার্কের উপন্যাস ‘রোডব্যাক’ বাংলায় অনূদিত করেছেন। 

তাঁর নিজের ভাই সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত পত্রিকা ‘পূর্বাশা’-য় তাঁর বহু গদ্য-পদ্য প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কয়েকটি কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছে। -- ‘রাতের রূপকথা’, ‘ঈগল ও অন্যান্য কবিতা’, ‘সৈনিক ও অন্যান্য কবিতা’। 

কলেজে পড়ার সময়ে নাটক রচনা করে কুমিল্লার টাউন হলে মঞ্চস্থ করেন। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়ও করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ নাটকে পানুবাবু, শরৎচন্দ্রের ‘ষোড়শী’ নাটকে জীবানন্দ এবং ‘রীতিমতো’ নাটকে অধ্যাপক দিগম্বরের চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করেছেন। 

‘অধিকার’, ‘শাপমুক্তি’, ‘মহাকবি কালিদাস’, ‘নিমাই সন্ন্যাস’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রের কাহিনী ও সংলাপ রচনা করেছেন।

দুটি চলচ্চিত্র পরিচালনা অবধি করেছেন। -- ‘অশোক’ এবং ‘ছদ্মবেশী’। এদের মধ্যে দ্বিতীয়টি উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মজার কাহিনী অবলম্বনে জহর গঙ্গোপাধ্যায় ও পদ্মা দেবী অভিনীত। এটি তাঁর মৃত্যুর পর মুক্তি পায় এবং বক্স অফিসে দারুণ ভাবে সাফল্য লাভ করে। পরে ‘ছদ্মবেশী’ সিনেমাটি উত্তম ও মাধবী রিমেক করেন। এটির কথা অনেকেরই মনে থাকবে। কিন্তু এর আগের অজয় ভট্টাচার্যের করা মূল সিনেমাটির কথা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন।

অজয় ভট্টাচার্য যুক্ত ছিলেন জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সঙ্গেও। স্কুল কলেজে পড়ানোর পাশাপাশি ছাত্রদের জাতীয়তাবোধে জাগরিত করার চেষ্টাও করে গেছেন নিরন্তর। ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কী রে’ জাতীয় গান থেকেই তাঁর দেশাত্মবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। শিক্ষাবিদ ড শঙ্কর সেন লিখেছেন—

‘অজয়বাবু স্যার জাতীয় সংগ্রামে জয়প্রকাশ নারায়ণ, করুণা আসফ আলী প্রমুখের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমাদের কয়েকজনকে তিনি তাঁর ছোটখাটো কাজেও লাগিয়েছিলেন। আমার আজও মনে পড়ে যে ঢাকুরিয়া লেকে নিয়ে গিয়ে আমাদের নেতাজীর কথা, হলওয়েল মনুমেন্টের কাহিনী আরও কত কথা শুনিয়েছিলেন’। 

অজয় ভট্টাচার্য রবীন্দ্র-নজরুল যুগ আর আধুনিক স্বর্ণযুগের গানের যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মিসিং লিঙ্ক হিসেবে কাজ করে গেছেন। এখনকার শ্রোতাদের কাছে তিনি আজ হয়তো একটি ভুলে যাওয়া অধ্যায়। তাঁর গানগুলি রবীন্দ্রসঙ্গীতের বা নজরুলগীতির মতো সযত্নে সংরক্ষিত হয়নি। কিন্তু তিনি আজও ফল্গুধারার মতো কিছু শ্রোতার স্মরণের গভীরে রয়ে গেছেন। আজও খেয়া বাইতে বাইতে মাঝিরা গেয়ে ওঠে—

‘ওরে সুজন নাইয়া, কোন বা কন্যার দেশে যাও রে চাঁদের ডিঙি বাইয়া’

কিংবা ‘বন্দর ছাড়ো যাত্রীরা সবে জোয়ার এসেছে আজ’। 

হয়তো গানখানি কার লেখা না জেনেই গেয়ে ওঠে। মানুষ চলে যায়, থেকে যায় তাঁর সৃষ্টি।



সংগীত বিষয়ক

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুই নক্ষত্র

~ মুনমুন চক্রবর্তী



প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় 

আমাদের দেশে কলা সাধনাকে বেদ মন্ত্র উচ্চারণের তুল্যই পবিত্রজ্ঞান করা হয়। বড় বড় মহর্ষিরাও কলাচর্চায় ব্যাপৃত হতেন। বহু বড় বড় ওস্তাদ এবং গুণী পন্ডিত ব্যক্তিরা তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। সেই রকম একজন গুণী ব্যক্তিত্ব হলেন শ্রী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। 


তিনি পাটনা শহরে ১৯২৬ সালের ১৫ ই আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই বহু বিখ্যাত সঙ্গীত ওস্তাদের গান শোনার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। এই ভাবেই তার মধ্যে শাস্ত্রীয় সংগীতের রসবোধ তৈরি হয়েছিল। তিনি নিজে সুরেলা কন্ঠের অধিকারীও ছিলেন। 

পদার্থবিদ্যায় graduation করার পর তিনি পুরোপুরি শাস্ত্রীয় সংগীতেই মনোনিবেশ করবেন ঠিক করলেন। এই সঙ্গীত ভালোভাবে রপ্ত করার জন্য শিক্ষার তাগিদে তিনি কলকাতায় আসেন। গুরুশিষ্য পরম্পরা মাধ্যমে শিক্ষা শুরু করলেন পন্ডিত যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। এর পরে তিনি জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে তালিম প্রাপ্ত হন। কিছুদিন পর তিনি এই সঙ্গীতে যথেষ্ট পারদর্শিতা লাভ করেন এবং আকাশবাণীর A- grade শিল্পী হিসেবে মান্যতা পান। 

১৯৫৭ সালে তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী মীরা চট্টোপাধ্যায় কে বিবাহ করেন এবং স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পাতিয়ালা ঘরানার ওস্তাদ 'বড়ে গোলাম আলি' র কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন তিনি 'Calcutta School of Music' -এ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা দান করেন। সমকালীন কলকাতা ও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের দরবারে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একটি উজ্জ্বল নাম। 

১৯৯৪-এ তিনি I.T.C পুরস্কার পুরস্কার পান। অনেক নামকরা বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে তিনি শিক্ষা দান করেন। তিনি ছিলেন একাধারে সুরকার ও গীতিকার। বেশকিছু চলচ্চিত্রে নেপথ্য শিল্পী হিসেবে কন্ঠে প্রদান করেন। 'যদুভট্ট' তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য। ১৯৯৬ সালের ২২ শে মার্চ তিনি পরলোকগমন করেন এবং রেখে যান অগণিত গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের।

 =======================================================


মীরা বন্দ্যোপাধ্যায় 

কণ্ঠসঙ্গীতের ক্ষেত্রে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এক বিপুল বিস্তার ও গভীরতায় নিমগ্ন। প্রচুর গায়ক তাদের স্বনামে ভাস্বর এই সঙ্গীতের মাধ্যমে। সেই সময় গায়করা অনেকে ছিলেন কিন্তু মেয়েরা সেইভাবে প্রকাশ্যে গান-বাজনা করতেননা। এক বাই সম্প্রদায় ছাড়া। 


কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের মত পরিবর্তিত হয় যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। পুরুষদের পাশাপাশি সমভাবে মহিলারাও সংগীতের প্রতি বিশেষভাবে আসক্ত হন। গান্ডা বেঁধে গুরুর কাছে সংগীত শিক্ষা শুরু করেন। বাংলায় ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এক নব বিবর্তন আনেন সঙ্গীতে, সাহিত্যে এবং পোশাক-পরিচ্ছদেও। 

এই রকমই এক সময় ১৯৩০ সালে ২৮ শে মার্চ মিরাটে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীমতি মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়। পিতা শ্রী শৈলেন্দ্র কুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ। কয়েক পুরুষ ধরেই তাদের বাস ছিল মিরাটে। 


সেই সময় টেলিভিশন ছিলনা, রেডিওতে নানারকম classical concert হোতো। কোনো কোনো অনুষ্ঠানে সঙ্গীতজ্ঞরা আমন্ত্রিত হতেন।এরকম অনেক অনুষ্ঠানে বাল্যকালে মীরা তার পিতার সঙ্গে উপস্থিত থেকে বহু গুণীজনের সংগীত শ্রবণ করেন। বাল্যকালে পিতার কাছে কিছুকাল শেখার পর কলকাতায় আসেন। তিনি ছিলেন অপূর্ব কন্ঠ স্বরের অধিকারিণী। অভিজাত পরিবারের কন্যা মীরা মাত্র ১৩ বছর বয়সে গুরু শ্রী চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে তালিম প্রাপ্ত হন। মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকেই তাঁর প্রতিভা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অল্প বয়সেই আকাশবাণীর শিল্পীদের তালিকায় তিনি নিজের নাম নথিভুক্ত করেন। ১৯৪৪ সালে "গীতশ্রী" উপাধি প্রাপ্ত হন। 

মীরার পিতৃ গুরু জলন্ধর নিবাসী পণ্ডিত শ্রী হরিশচন্দ্র বালি মীরার সংগীত প্রতিভায় এতটাই আপ্লুত ছিলেন যে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য বন্দিশ মীরাকে শিখিয়েছিলেন। সেইসব বান্দিশ গেয়ে তিনি প্রচুর প্রশংসা পেয়েছিলেন। 

১৯৫০ সালে মীরা পাতিয়ালা ঘরানার ওস্তাদ গোলাম আলীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং যতদিন ওস্তাদ জীবিত ছিলেন মীরা তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। নিঃসন্দেহে মীরা ছিলেন পাতিয়ালা ঘরানার একজন পথপ্রদর্শক। ১৯৫৩ সালে আকাশবাণীর ন্যাশনাল প্রোগ্রামে তিনি প্রথম লাইফ করেন। তার পরের বছরই ভারত সরকারের আনুকূল্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সংগীত পরিবেশন করে প্রভূত প্রশংসা অর্জন করেন। রাষ্ট্রপতি ভবনেও তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেই সময় তার বেশ কিছু রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল যা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৫৭ সালে তিনি সঙ্গীতজ্ঞ শ্রী প্রসূন ব্যানার্জীকে বিবাহ করেন। ১৯৬২ সালে নেপাল সরকারের দ্বারা আমন্ত্রিত হন, বাংলাদেশেও সংগীত পরিবেশন করেন। বহু ছায়াছবিতেও নেপথ্য কন্ঠ সঙ্গীত প্রদান করেন। "অতিথি" ছবি তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য।


১৯৯৬ সালে ITC, SRA পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৯ তে পান Bengal State Academy Award, Bhuwalka award, G.L Mehta award. এছাড়াও সিদ্ধেশ্বরী পুরস্কার, স্বরসিদ্ধি এরকম অনেক পুরস্কার লাভ করেন। 

২৮শে জুন, ২০১২ তে তিনি পরলোকগমন করেন। তিনি রেখে গেছেন অনেক ছাত্র-ছাত্রী যারা তারই উপযুক্ত পথ বাহক, বাহিকা।



চিকিৎসা বিঞ্জান

মৌসুমি বিষন্নতা


 ~ ডাঃ সোমা মৈত্র



মৌসুমি বাতাস জানান দিচ্ছে শীত এসে গেল । শীত বুড়ি তার বিবর্ণ চাদর গায়ে দোরগোড়ায় হানা দিলেও এই শীতের রয়েছে এক অপরূপ সৌন্দর্য্য। শীতের ঠান্ডা বাতাস আর শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় মুক্তোর মতো দানা, ভোরের কাঁচা রোদ, হিমেল হাওয়া আর বাতাসে খেজুর গুড়ের গন্ধে পৌষের আলিঙ্গন। পৌষ মানে খেজুর গুড়ের পায়েস আর পিঠেপুলি, এসব মিলেমিশে মন ছেয়ে যায় আশ্চর্য্য এক ভালোলাগা ভালোবাসার অনুভুতিতে ।

এত ভালোলাগা ভালোবাসার মাঝেও কিন্তু কখনো কখনো অজানা এক মন খারাপ, ভালো না লাগাতে পেয়ে বসে মন। যেমন হয় রিয়ার । রিয়া বি এস সি অনার্সের ছাত্রী। পড়াশোনায় খুব ভালো। কিন্তু শীতকাল এলে কি যে হয় কিছুই ভালো লাগে না রিয়ার, কোন কিছুতে মন বসেনা । কারন ছাড়াই ভীষন এক বিষন্নতায় ছেয়ে যায় মন। অনেক ভেবে কোনো কারনই খুঁজে পায় না রিয়া এবং খেয়াল দেখেছে শীতকাল এলেই এই মন খারাপের পালা শুরু হয় তার । ঘন্টার পর ঘন্টা শুয়ে থাকে, কিভাবে উঠবে বুঝতে পারে না। এমন কি প্রাত্যহিক মুখ ধোয়া, স্নান করা, জল খাওয়া, খাবার খাওয়া কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। 


মন খারাপ আমাদের সকলেরই হয় । কোন কোন সময় কারন ছাড়া আর বেশীর ভাগ সময় নানা কারনে মন খারাপ হওয়া এ আমাদের জীবনের অঙ্গ । কিন্তু রিয়ার মতো অনেকেরই মন খারাপ হয় বছরের নির্দিষ্ট কোনো ঋতুতে, কখনও শীতকালে কখনো বা অন্য কোন ঋতুতে । যেহেতু বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এই মনখারাপ হয় যেমনটা হয়েছে রিয়ার শীতকালে তাই একে বলা হয় মৌসুমী ব্যাধি বা সিজিনাল এফেক্টিভ ডিসঅর্ডার আর সংক্ষেপে বলা হয় এসএডি (SAD) । এই সিজিনাল এফেক্টিভ ডিসঅর্ডার কে অনেক সময় শীতজনিত বিষন্নতা বা শীতজনিত রিঅ্যাকশানও বলা হয়ে থাকে। দেখা গেছে পুরুষের তুলনায় নারীরাই এসএডি তে আক্রান্ত হয় বেশি। আবার তুলনামুলক ভাবে বয়স্কদের চাইতে কমবয়সীদের মধ্যে এর প্রকোপ বেশি দেখা যায় । বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে ১০ বিলিয়ন মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়। এছাড়া বিষুবরেখা থেকে যারা দূরে বসবাস করে তাদের ক্ষেত্রে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায় ।


এখন প্রশ্ন হল কার এসএডি হয়েছে বোঝা যাবে কিভাবে । মন খারাপ তো সকলেরই হয় কিন্তু যদি দেখা যায় বছরে নির্দিষ্ট কোন ঋতুতে এই মন খারাপের অনুভুতি ভীষনভাবে বেড়ে যায় ফলে মানুষ্টির দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যহত হচ্ছে তাহলে আমাদের সতর্ক হতে হবে এবং লক্ষণ ও উপসর্গগুলির দিকে খেয়াল রাখতে হবে। একটা কথা মনে রাখা দরকার সিজিনাল এফেক্টিভ ডিসঅর্ডার বা এসএডি (SAD) কোনো রোগ নয় একে বিশৃঙ্খলা বলা যেতে পারে।

এবার জেনে নেওয়া যাক সিজিনাল এফেক্টিভ ডিসঅর্ডার বা এসএডি (SAD) এর উপসর্গগুলি কি কি

সিজিনাল এফেক্টিভ ডিসঅর্ডার এর লক্ষণ ও উপসর্গ 

বিভিন্ন মানুষের ওপর এই বিশৃঙ্খলার প্রভাব বিভিন্ন রকমের হতে পারে । সুতরাং এর উপসর্গগুলো এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হতে পারে । যাইহোক কতগুলো উপসর্গ যা সকলের ক্ষেত্রেই একরকম সেইগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।


১) দিনের বেলায় সবাই যখন পরিপূর্ন এনার্জি নিয়ে কাজ শুরু করে তখন ভীষন ভাবে ক্লান্ত অনুভব করা ।

২) মনোযোগ দিয়ে কোন কাজ করতে না পারা।

৩)অস্থিরতা ।

৪) সবকিছুতে বিরক্ত লাগা ।

৫) সব কাজেই উৎসাহ কমে যাওয়া ।

৬) অকারণে মন খারাপ হওয়া ।

৭) রাগ অসম্ভবভাবে বেড়ে যাওয়া ।

৮) নিজেকে অসহায় এবং নির্বোধ ভাবা ।

৯) ভাললাগার জিনিসগুলিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা ।

১০) কোনকিছু খেতে অনিহা এবং খিদে কমে যাওয়া ।

১১) ঘুমের সমস্যা।

১২) ওজন ভীষনভাবে কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া ।

১৩) নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করা 

১৪) কার কারো ক্ষেত্রে শর্করা জাতীয় খাবারের প্রতি আসক্তি বেড়ে যাওয়া।

১৫) মানুষজন থেকে দূরে থাকতে ভালোলাগা ।


এই বিশৃঙ্খলতার কারনগুলি কি কি :-

আমাদের মস্তিস্কে সেরোটনিন নামক এক মনোঅ্যামিন নিউরোট্রান্সমিটার থাকে যা মানুষের মেজাজের পরিবর্তন ঘটায়। শীতকালে দিনের বেলায় সূর্‍্যরশ্মির প্রখরতা কমে যায় ফলে তাপমাত্রাও যায় কমে ফলস্বরূপ সেরোটনিনের তারতম্যতা ঘটে যা মানুষের আভ্যন্তরীন বায়োলজিক্যাল ক্লক (Carcadian rhythm ) এর পরিবর্তন ঘটায় । এই কারনে কারো কারো ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন সিজিনাল এফেক্টিভ ডিসঅর্ডারকে ডেকে আনে। অনেকের ক্ষেত্র ভিটামিন ডি এর ঘাটতিও এ বিশৃঙ্খলার কারন হতে পারে । জেনেটিক লোডিংও এর কারন হিসেবে গন্য করা যায় । 


কারন যাই হোক না কেন ঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে এই অসুবিধা থেকে আমরা সহজেই বেরিয়ে আসতে পারি। এর জন্য কেবল দরকার ইতিবাচক মানসিকতা । তাই এ ধরনের অসুবিধা হলে কাউন্সিলার, সাইকোলজিস্টদের সাহায্য নিন ।এই অসামান্য জীবনটাকে অবহেলায় নষ্ট হতে না দিয়ে আনন্দে এবং খুশিতে বাঁচতে পারি এই হোক আমাদের অঙ্গীকার ।


চিকিৎসা বিঞ্জান

শীতকালে ত্বকের সমস্যা

~ ডাঃ শর্মিষ্ঠা দাস 



এলো যে শীতের বেলা। রঙবেরঙের সিমলা মরিচ ডাকে --আয়। বেগুন গাজর বাঁধাকপি কড়াইশুঁটি সবাই ডাকে --আয় আয়। বাগান আলো করে ফোটে ডালিয়া চন্দ্রমল্লিকা পিটোনিয়া --- হরেক রকম মরশুমি ফুল। গরমের দেশে গোনা গুনতি কদিনের ঠান্ডাকে জমিয়ে উপভোগ করতে কখনো পিকনিক, কখনো গরম কফি আর আড্ডা। শীতকাল ছাড়া কি আর সিমলা মানালী থেকে কেনা শাল ওভারকোটের সদ্ব্যবহার হয়! 

এভাবে শীতকাল তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার সময়েও কারো কারো মনখারাপ হয়ে যায়। কারণ মানুষের ত্বক না হাসলে মুখেও যে হাসি ফোটে না। শুকনো খড়ি ওঠা গা দেখে কান্না পায়, ফেটে চৌচির গোড়ালির জন্য হু হু করে ওঠে প্রাণ। 


এসব সমস্যার মোকাবিলা করতে গেলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে -- কেন শীতকালে ত্বক শুকনো হয় ?

ত্বকের উপরিভাগে যে কোষগুলো থাকে, তা সর্বদাই জন্ম নিচ্ছে আবার পরিণত হয়ে ঝরে পড়ছে আমাদের অজান্তেই । প্রতিনিয়তই ত্বকের মাধ্যমে  শরীরের জল বেরিয়ে আবহাওয়ায় মিশছে--কখনো অদৃশ্যভাবে , কখনো ঘাম হয়ে । এই জল নিষ্কাশন নির্ভর করে আবহাওয়ার তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার উপর । শীতকালে আবহাওয়াতে আর্দ্রতার পরিমাণ অতিরিক্ত কম হওয়ার কারণে, সহজেই কোষের জল বাষ্প হয়ে বেরিয়ে আসে। তার জন্যেই যত রুক্ষতার  সমস্যা । 


দৈনন্দিন কোন অভ্যাসে শীতকালে ত্বক বেশী ফাটে? কি কি করলে ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতা নষ্ট হয়? 


১) অতিরিক্ত ক্ষারযুক্ত সাবান ব্যবহার করলে এবং খুব বেশি সময় ধরে বার বার সাবান ঘষলে। 

গায়েমাখা সাবানের pH মোটামুটি ৫•৫ এর কাছাকাছি থাকা বাঞ্ছনীয়।

২) খুব বেশি গরমজলে চান করলে । শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে মানানসই উষ্ণ জলে চান করা উচিত ।

৩) একটানা অনেক সময় ধরে জল ঢেলে স্নান করলে জলের সঙ্গে কোষের আর্দ্রতাও নষ্ট হয়ে যায়। দশ মিনিটের বেশি সময় নিয়ে স্নান করা, বারে বারে স্নান করলে ত্বক রুক্ষ হয়।

৪) খুব বেশি সময় এসি বা রুম হিটার যুক্ত ঘরে থাকলে 

৫) খুব বেশি রগড়ে স্নান করার অভ্যাস থাকলে । গামছা, ছোবড়া ইত্যাদি দিয়ে বেশি রগড়ে স্নান করলে ত্বকের বাইরের দিকে স্তর থেকে কোষগুলি অপরিণত অবস্থায় ঝরে পড়ে । ফলে কোষের স্বাভাবিক আর্দ্রতা নষ্ট হয় । 

৬) দীর্ঘসময় বাইরে রোদে থাকলে ।


এই কারণগুলো জানা হল --এবার এই অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করে একটু সতর্ক হলেই ত্বকের কোষের আর্দ্রতা বজায় রাখা সম্ভব। এজন্য সবসময় গাঁটের কড়ি খরচ করে ডাক্তার দেখানোর দরকার পড়ে না বা দামি দামি দেশী বিদেশী ক্রীম মাখারও কোনো প্রয়োজন নেই । সামান্য খরচেই ত্বকের রুক্ষ ভাব দূর করা যায়।

মূলকথা হল ত্বক একটু তৈলাক্ত রাখতে হবে । শীতকালে যদি খেয়াল রেখে দুবার নারকেল তেল বা অলিভ তেল বা ভেসলিন মাখা যায় --তাহলেই ত্বক মসৃণ থাকবে । ইউরিয়া বা প্যারাফিন যুক্ত ময়েশ্চারাইজিং ক্রিমও ভালো কাজ করে। 


কিছু চর্মরোগ আছে যা শীতকালে বাড়ে। এই রোগীরা পুজোর মাসের শেষেই যেই উত্তুরে হাওয়া বয় --ভয়ে ভয়ে থাকেন। জানেন কষ্টের দিন শুরু। 

কোন কোন অসুখের কষ্ট শীতকালে বাড়ে? 

সোরিয়াসিস --এই দীর্ঘস্থায়ী চর্মরোগ যাদের আছে, শীত আসার আগেই তাদের সাবধান হওয়া উচিত । সোরিয়াসিসে যে খোসা ওঠা ব্যাপারটা হয় তা বহুগুণ বেড়ে যায় শীতে। এই রোগীদের শুধু নারকেল তেলেও অনেক সময় কাজ হয় না--লিকুইড প্যারাফিন মাখতে হয় । সঙ্গে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য ওষুধপত্র। 

অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস --যেসব শিশুদের এই সমস্যা আছে তাদেরও উপযুক্ত ময়শ্চারাইজিং ক্রিম মাখা দরকার। 


মীনচর্ম বা ইকথাইওসিস -- একটি জন্মগত ও বংশগত রোগ। রোগীদের ত্বক এত বেশি ফাটা থাকে যে মাছের আঁশের মতো দেখতে লাগে । এই রোগীরা শীতকালে খুবই কষ্ট পায় । উপযুক্ত তেল, ইউরিয়া যুক্ত ময়শ্চারাইজিং ক্রীম মাখা অত্যাবশ্যক । সঙ্গে আছে ঢাকা পোষাক,সাবান কম ব্যবহার।

খুসকি শীতকালে বেশী হয় । প্রয়োজন উপযুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করা।


এছাড়া হাইপোথাইরয়েড রোগী, বয়স্ক মানুষ --এদেরও ত্বক শীতকালে অন্যদের চাইতে বেশি ফাটে । এতক্ষণ ত্বক তৈলাক্ত রাখা ও আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য যা যা বলা হল সেই বিধি মেনে চললেই অপেক্ষাকৃত ভালো থাকবেন। 


শীতে যদি ত্বকের রুক্ষতার দাঁত খিঁচুনি না থাকে -- যদি ত্বকে বসন্তের হাওয়া বয় --তাহলে মন্দ কি! এইসব স্বাস্থ্যবিধিমেনে চললেই তা সম্ভব বই কি । 



তুলিকলম

শিশির ফোঁটায় তুলির টান

~ সুভম মুখার্জী

(সহযোগী সম্পাদক, হিরণ্যগর্ভ ও সম্পাদক, তুলিকলম)



ঘুমের দেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে শিরশিরে হাওয়া জাগিয়ে দিয়ে জানান দেয় 'চিঠি এসেছে'...। একখানি বড় খাম। খাম খুলতেই একটা বড় সাদা কাগজ বেরিয়ে এল। তার সঙ্গে একটা চিরকুট। তাতে লেখা 'কুয়াশা মাখা সকাল, সঙ্গে হালকা ঠান্ডা হওয়ার আমেজে নরম পিঠে আর নলেন গুড়ের পায়েস... আগুন জ্বালা রাতে গোল হয়ে বসে জুড়ে দেওয়া গল্প … লেপ জড়িয়ে চুপটি করে ঝিঁঝিঁর ডাক… ভেজা মেঠোপথের পাশে ঘাসে শিশির জমেছে… অনেক শিশির...পলাশ যে দিগন্ত রাঙাতে শুরু করেছে...তুমি বেরোবে না?" সে চিঠির টানে মাটির পানে পা এমনিই হেঁটে গেল...বুক ভরে ঠান্ডা নিশ্বাস নিয়ে মনে হলো "এই তো, চিঠির সব কথাগুলো মিলে গেল!" শিশির তুলে এনে তুলিটাকে স্নান করাতেই সে শিউরে উঠলো...একটা খিলখিলিয়ে ওঠা হাসি কানে কানে বললো, "এবার রাঙিয়ে দাও..."। সাদা ক্যানভাসে পলাশ ফুটল। দিগন্তের মত রাঙা হয়ে উঠল মন। শিশির ভেজা তুলির টান শীতের হিমেল পরশ ছুঁয়ে দিয়ে বললে, "চলো তবে! ভেজা ঘাসের উপর, কুয়াশা মোড়া পুকুর ধারে..বসন্তের অপেক্ষায় না থেকে এখনই রঙের খেলায় মাতি!"..মন প্রাণ একছুট্টে চলল সেদিক পানে.....।

===============================================================================


শিশুশিল্প

অদ্রিজা রায়চৌধুরি

অভীপ্সা ব্যানার্জী

অভীপ্সা ব্যানার্জী

  

বয়স : ৪ বছর

অভীপ্সা ব্যানার্জী

অভীপ্সা ব্যানার্জী

অভীপ্সা ব্যানার্জী

  

বয়স: ১০ বছর

রায়ান দত্ত

অভীপ্সা ব্যানার্জী

রুদ্রনীল সরকার

  

বয়স: ৭ বছর

রুদ্রনীল সরকার

অঙ্কুশ চৌধুরী

রুদ্রনীল সরকার

  

বয়স: ৮ বছর 

অঙ্কুশ চৌধুরী

অঙ্কুশ চৌধুরী

অঙ্কুশ চৌধুরী

  

বয়স: ৮ বছর

  • অন্দরমহল
  • বর্তমান সংখ্যা
  • আগামী সংখ্যা
  • লেখা পাঠান
  • চালচিত্র
  • যোগাযোগ

হিরণ্যগর্ভ (বাংলা সাহিত্য পত্রিকা)

বেঙ্গালুরু - শিলিগুড়ি

+৯১-৯৯৪৬১৮৬২৩১/ +৯১-৯৭৩৪০০৯৪৪০


Copyright © 2021 hiranyagarvo - All Rights Reserved


Web Design & Concept by Subhradev Sen


An offering of "Hiranyagarvo Publication House"

পৌষ ১৪২৭ সংখ্যা

পড়ুন