পৌষ সংখ্যা ১৪২৭ বিষয়: পিঠে পুলি নবান্ন, পৌষ মানে কি পূর্বাহ্ণ?

hirayagarvo
hirayagarvo
  • অন্দরমহল
  • বর্তমান সংখ্যা
  • আগামী সংখ্যা
  • লেখা পাঠান
  • চালচিত্র
  • যোগাযোগ
  • More
    • অন্দরমহল
    • বর্তমান সংখ্যা
    • আগামী সংখ্যা
    • লেখা পাঠান
    • চালচিত্র
    • যোগাযোগ

  • অন্দরমহল
  • বর্তমান সংখ্যা
  • আগামী সংখ্যা
  • লেখা পাঠান
  • চালচিত্র
  • যোগাযোগ

পৌষ ১৪২৭

বিষয়: পিঠেপুলি নবান্ন, পৌষ মানে কি পূর্বাহ্ণ ?

  

 প্রকাশ: ২১ শে চৈত্র, ১৪২৭

======================

সম্পাদকীয়

শীত মানে তো একপ্রকার সংকোচন। শীত মানে জড়তার এক রঙীন বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃতি সেজে ওঠে এক রুক্ষ্ম অথচ সিক্ত রূপে। আলস্য আর জড়তা আচ্ছন্ন করে মস্তিষ্কের উদ্ভাবনী শক্তির উল্লাসকে। শীতেই তো আমরা আহ্বান করি অনন্ত বছর ধরে বিস্মৃত হওয়া অন্তরের শক্তিকে। আর মহাতেজী সূর্য এর সঙ্গ দেয়।

পৌষ যেমন বয়ে আনে আচরণের ভেদাভেদ তেমনি কখনও বয়ে আনে নৈরাশ্য, কখনও আনে বিহ্বলতায় আত্মনিমজ্জন। নৈরাশ্য কে কাটিয়ে তোলার সামগ্রিক প্রচেষ্টা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে নতুন প্রাণসঞ্চারকে যা প্রকৃতিকে করে শস্যশ্যামলা- সামাজিক কাঠামোকে করে তোলে উৎসবমুখর আর রসনার পরিতৃপ্তিতে মানুষ খুঁজে চলে মিলনের প্রগাঢ় উৎসাহ। বাংলার দিকে দিকে জেগে ওঠে মিলনমেলা, সঙ্গীতানুষ্ঠান ও খাদ্যরসিকদের নিরলস আড্ডা। দিন ছোট হয়ে আসে, রাত হয় দীর্ঘ ও গভীর যতক্ষণ না সূর্য তার গতিকে করে তোলে একটু ভিন্ন মাপের। 


বাংলার আবেগে মকর সংক্রান্তি বহু যুগের। পৌষের সংক্রান্তিতে যেন প্রকৃতির এক অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়ে শুরু হয় দীর্ঘ ও সুদৃঢ় আলোকপাতের অপেক্ষা। শুধু বাংলাতেই নয় এই সংক্রান্তি বিভিন্ন নামে ও আঙ্গিকে উদযাপিত হয় ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে। হিন্দুধর্মের বেশিরভাগ উৎসবই চন্দ্রের চক্রাগতির উপর নির্ধারিত কিন্তু পৌষের সংক্রান্তি এর ব্যাতিক্রমী যা সূর্যের চক্রাগতির সাথে যুক্ত। শীতের একাকিত্ব কাটানোর উৎসব এই পৌষের সংক্রান্তি। মানুষের আধ্যাত্মিক ও বৌদ্ধিক উন্নতির জন্য এই আয়োজনকে জোরালো মনে করা হয়। এই পূণ্য উৎসবে ধুয়ে মুছে যায় অতীতের দুষ্কর্ম ভারতের বৃহতাকার নদীগুলিতে স্নানের মাধ্যমে- সঞ্চার হয় উজ্জীবিত প্রাণের। প্রতি বারো বছর অন্তর মকর সংক্রান্তির সাথে কুম্ভের মেলা জনমানসের শক্তিস্তরে দেয় অন্য মাত্রা। তবুও যেন শীত বেশী উদাস, একটু বেশীই রুক্ষ্ম। তাই তো ভাতৃত্ব ও একাত্বতার নিবিড় বন্ধনের প্রতীক হিসাবে তৈরী করা হয় স্বয়ং অন্নপূর্ণার আশীর্বাদে পুষ্ট ঘন নিবিষ্ঠ মিঠাই।  রসনার তৃপ্তি আর জড়তার উন্মেষ যেন ভোরের ফুলকপির ঘুম ভাঙাকে আরও আকর্ষনীয় করে তোলে।


এই সংখ্যায় হিরণ্যগর্ভের প্রয়াস এই জড়তা থেকে উজ্জীবনের আনন্দকে একটি স্তবকে একত্রিত করা। একটি প্রয়াস রইল, বিষাদ ও আনন্দের এই বৈপরিত্যকে অন্তরে অনুভব করার শীতের কুয়াশার মায়াময় পাশের মধ্যে। হয়তো সূর্যের মিষ্টি আবেশ সকলকে ভুলিয়ে দেবে যে কখনও আমরা ঘুমিয়েছি, কখনও আমরা ভুলেছি আত্মপরিচয়। যদিও মনের গভীরে যেন শুনতে পাই –


কি মৃত দেশ, কি স্তব্ধ জগৎ,

আরাবে কি নীরবতা, কি জড়তা বেগে

কভু কি মানুষ বাসি এই জড় দেশে

নিজ প্রাণ সঞ্চারিয়া করিবে সজীব?

নাই কি পুরুষ তবে এই প্রকৃতির?”

প্রত্যাখ্যাত যেন ভয়ে চিন্তা ফিরে আসে

নিজ নীড়ে। স্পন্দহীন ভূমি পূর্ববৎ।


(“কাহিনী ও কবিতা”, শ্রীঅরবিন্দ)  


  

শুভ্রদেব সেন 

প্রধান সম্পাদক

২১ শে চৈত্র, ১৪২৭ 

প্রবন্ধ

দুই চরকের গল্প

~ অনিন্দ্য পাল 


মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম ওষুধ কোনটা? প্রথম ডাক্তারি উপদেশই বা কে, কোথায় দিয়েছিলেন? এসব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া মুশকিল, তবে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, ৩৫০০ বছর আগে উইলো গাছের ছালই ছিল এখনো পর্যন্ত জানা সবচেয়ে পুরানো ব্যবহৃত ওষুধ। প্রাচীন সুমেরীয় এবং ইজিপ্সিয়ানরা এই ওষুধ ব্যবহার করত, যন্ত্রণা কমাতে, অর্থাৎ আজকের অ্যাসপিরিন জাতীয় পেইনকিলার এর জন্ম এভাবেই হয়েছিল। খৃষ্টপূর্ব ২১১২-২০০৪ এই সময়ের মধ্যে সুমেরীয়রা সম্ভবত প্রথম চিকিৎসা এবং ওষুধের প্রয়োজনমুলক ব্যবহার করতো, এমনটাই বলছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা। 


ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতার একটা বড় অবদান " আয়ুর্বেদ " । কে বা কারা এই আয়ুর্বেদচর্চা শুরু করেছিল, এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও গবেষক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে যে, এই চিকিৎসা পদ্ধতি ভারতে বৈদিক যুগ থেকে বা আরো আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। লক্ষ শ্লোক নিয়ে প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসার প্রমাণ বহন করছে "আয়ুর্বেদ", যতদূর জানা যায় এর রচনাকাল ১০০০ খৃষ্টপূর্ব, অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ৩০০০ বছর আগে।

 

আজকের পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়ানো অ্যালোপ্যাথির জন্ম উনিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে, এবং এর নামকরণ করেছিলেন হ্যানিম্যান, হোমিওপ্যাথির জনক। কিন্তু আয়ুর্বেদচর্চা ভারতের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি, এবং একসময় শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল এই চিকিৎসা পদ্ধতি। খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে আয়ুর্বেদচর্চার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুই চিকিৎসক আত্রেয় এবং সুশ্রুত, আয়ুর্বেদকে  প্রকৃত ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে গড়ে তুলে ছিলেন। কোন কোন গবেষকের মতে আত্রেয় তক্ষশীলার বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন। বেশ কিছু চিকিৎসা গ্রন্থ ও লিখেছেন তিনি, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য "আত্রেয় সংহিতা "। বিভিন্ন ধরনের রোগ, দ্রব্যগুণ, ভেষজ চিকিৎসাবিধান এই সব নিয়ে লেখা এই গ্রন্থ পরবর্তী সময়ে আরও অনেক চিকিৎসা সহায়ক গ্রন্থ লেখার উৎসাহ দিয়েছিল। সুশ্রুত, আত্রেয় - এর একটু পরের , বৈদিক যুগের মাঝামাঝি বা শেষভাগে তিনি ছিলেন। সম্ভবত কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করতেন, শল্যবিদ্যায় ছিলেন পারদর্শী। তিনিও "সুশ্রুত সংহিতা" নামে একটা চিকিৎসা গ্রন্থ লেখেন। তবে আত্রেয় সংহিতা এবং আত্রেয়র চিকিৎসা পদ্ধতির যিনি পরিপূর্ণতা দিয়েছিলেন তাঁর নাম "চরক"। আত্রেয়র পরবর্তী অগ্নিবেশ আত্রেয়র চিকিৎসা পদ্ধতিতে যে চিকিৎসা করতেন, তাঁর নথি সম্ভবত ছিল "অগ্নিবেশসংহিতা" য়, কিন্তু এই বইটা পরে আর পাওয়া যায় না, এর কারণ হিসেবে বলা হয়, অগ্নিবেশের শিষ্য "মহর্ষি চরক" ওই বইটির সম্প্রসারণ এবং সংশোধন করেন, জন্ম হয় চরক-সংহিতার। পরবর্তী সময়ে এই চরক-সংহিতা হয়ে উঠেছিল ভারতীয় আয়ুর্বেদচর্চার প্রধান আকর গ্রন্থ। এই গ্রন্থে মানুষের শরীর এবং বিভিন্ন রোগের অত্যন্ত সুন্দর বর্ণনা এবং ব্যাখা আছে যা আজও আধুনিক চিকিৎসকদের কে অবাক করে। মূলত আটটা ভাগে বিভক্ত এই চরক-সংহিতা। প্রথম ভাগে আছে খনিজ, প্রাণীজ এবং উদ্ভিজ্জ, এই ধরনের বস্তুর গুণাগুণ। প্রাণীর দেহে জীবন্ত বা মৃত অবস্থায় অণুজীবের অনুপ্রবেশই যে অনেক রোগ সৃষ্টির কারণ তার বিস্তারিত আলোচনা এই প্রাচীন বইটাতে পাওয়া যায়, যা আজকের যুগে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে দেখলে অত্যন্ত বিস্ময়কর মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।


দ্বিতীয় ভাগে পাওয়া যায় বিভিন্ন রোগের লক্ষণ এবং পরিচয়। এই অংশে দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের কথাও বলা হয়েছে। মানুষের দেহ আর মনের পরিচয় পাওয়া যায়  তৃতীয় ভাগে। এই অংশে শরীরের সঙ্গে মনকেও রোগ সৃষ্টির কারণ হিসেবে গন্য করা হয়েছে। চতুর্থ ভাগের আলোচনার ক্ষেত্র মানুষের শরীর বা "শারীর বিজ্ঞান"। সেই প্রাচীন কালে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, হাড়, মাংসপেশি, শিরা উপশিরা, হৃৎপিন্ড, চোখ কান প্রভৃতি সম্পর্কে খুব বিস্ময়কর আলোচনা এই অংশে পাওয়া যায়। এমনকি দাঁত ও নখ সমেত শরীরে হাড়ের সংখ্যা ৩৬০ এই উল্লেখ ও পাওয়া যায়। এছাড়াও রক্ত সঞ্চালন, পরিপাক স্পর্শ, গর্ভস্থ সন্তানের রক্ত প্রবাহ এবং মায়ের রক্ত প্রবাহের মধ্যে যে মায়ের হৃৎপিন্ড প্রধান ভূমিকা নেয় তাও বলা আছে, যা আজও বিস্ময় জাগায়। না অণুবীক্ষণ যন্ত্র , না অন্য কোন উন্নত যন্ত্রপাতি, বলতে গেলে আধুনিক প্রযুক্তির কোন কিছুই ছিল না যখন, তখন এই রকম গবেষণা, পর্যবেক্ষণ আর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি করা চিকিৎসা পরিকাঠামো সত্যিই অবাক করে। 

পঞ্চম ভাগে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে কেমন লক্ষণ দেখা গেলে কোন ধরনের রোগ হতে পারে বা ভবিষ্যতে হতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আবার ষষ্ঠ ভাগে বিভিন্ন ধরনের রোগ এবং সারানো সম্ভব নয় এমন রোগের চিকিৎসা এবং ওষুধের কথা বলা হয়েছে। সপ্তম ভাগে চিকিৎসকদের জন্য উপদেশ আর অষ্টম ভাগে শপথের কথা বলা হয়েছে। 


"যাত্যুদীর্ণং শময়তি নান্যং ব্যাধিং করোতি চ।

যা ক্রিয়া ন তু যা ব্যাধিং হরতান্য মুদিরয়েৎ।।"


অর্থাৎ, যা ব্যাধি উপশম করে এবং নূতন ব্যাধির সৃষ্টি করে না সেই চিকিৎসাই উপযুক্ত চিকিৎসা - এটি চরক সংহিতার মূল সূত্র গুলোর একটা। 


ইউরোপে চিকিৎসকরা চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে রসায়নের একটা গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন, কিন্তু সে ঘটনা ঘটার অনেক অনেক বছর আগেই ভারতে সুশ্রুত, চরক প্রভৃতি আয়ুর্বেদ চিকিৎসক তাঁদের মত করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে রসায়নের ব্যবহার করতে শুরু করেন। এমনকি রসায়ন শব্দটাও "অথর্ব বেদ"- এর ' অয়ষ্যাণি ' শব্দ থেকে, যার অর্থ দীর্ঘ জীবন এবং স্বাস্থ্য লাভের উপায়। চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা, এই দুই গ্রন্থেই সোনা, রুপো, তামা, সীসা, টিন, লোহা এই ছটা ধাতু এবং বিভিন্ন লবণ, ক্ষার ও ক্ষারক তৈরি, সন্ধান পদ্ধতিতে তৈরি প্রায় ৮৪ রকম পানীয় তৈরির পদ্ধতি বলা আছে। যৌগিক পদার্থের সম্পর্কে ধারণা ও আলোচনা করা হয়েছে। শোরা বা সোরা, সৈন্ধব লবণ বা রক সল্ট, বিট লবণ, উদ্ভিজ্জ লবণ এবং সামুদ্রিক লবণ, তুঁতে, মোমছাল, হরিতাল, গন্ধক এই ধরণের খনিজের কথাও আলোচনা করা হয়েছে। এই সব অভিনব এবং সুচিকিৎসার আলোচনা ছিল বলেই এই চরক সংহিতা সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু 'চরক' কে ছিলেন? না এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবার মত প্রামাণ্য তথ্য এখনও মেলেনি। পুরাণ এবং পৌরাণিক কাহিনীর বিভিন্ন অংশে উল্লিখিত লেখা থেকে সামান্যই জানা যায়। চরক সংহিতার চরক আত্রেয় অগ্নিবেশের পরে, একথা স্বীকার করলেও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ " ত্রিপিটক "- এ এক চরকের উল্লেখ পাওয়া যায়। এখন  গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী সূত্রে যে চরকের কথা জানা যায়, গ্রন্থ অনুযায়ী তাঁর কাল খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক, কিন্তু ত্রিপিটক এর চীনা অনুবাদ থেকে পাওয়া যায় আর এক চরকের নাম, সেখানে চরক কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের প্রধান চিকিৎসক। এই চরকের সময় কাল খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে কোন একটা সময় হতে পারে, কারণ কনিষ্কের রাজত্ব কালও এমনি অস্পষ্ট সময়কালে। এই কারণে অনেকেই মনে করেন চরক দুই জন ছিলেন, এক সংহিতার চরক, অন্যজন চিকিৎসক চরক। 


প্রবন্ধ

বালুচরির ইতিকথা

~ তরুনার্ক লাহা



বালুচরি শাড়িটা পেয়ে ছবিতা যেন বসন্তের পলাশ। চিকচিকে আনন্দ চোখে মুখে।পাশে দাঁড়িয়ে প্রতুল দেখছে আনন্দিত স্ত্রীকে। ছবিতার বহুদিনের সখ একটা বালুচরি শাড়ি কেনার। প্রতুলের সাধ থাকলেও সাধ্যি ছিল না।এবারে হঠাৎ একটা সুযোগ এল হাতে।বিষ্ণুপুরের এক বন্ধু তাকে অফারটা দিল---একটা দামী বালুচরি নিয়ে যা।দামের জন্য চিন্তা করিস না।কিস্তিতে মেটালেই চলবে।কথা দিচ্ছি বৌএর মনে যতটুকু জায়গা ফাঁকা রয়েছে এই বালুচরি প্রাপ্তিই সেই শূণ্যস্থান পূরণ হয়ে যাবে।

প্রতুল পছন্দ করে শাড়িটা নিয়ে আসে।ছবিতার জন্মদিনে উপহার দেয়।শাড়ি পেয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বহুক্ষণ।অপূর্ব সব চিত্রকলা।মহাভারতের একটা খন্ডচিত্র শাড়ির আঁচল জুড়ে।শাড়িটা গায়ে জড়ালেই এক আলাদা অনুভুতি।প্রতুল মুচকি হেসে বলে---ছবিতা,এ কোনো বাজারে কেনা আর পাঁচটা শাড়ির মতো নয়।এর একটা ইতিহাস আর ঐতিহ্য আছে।

ছবিতারও ভীষণ কৌতুহল এই শাড়ি সম্পর্কে জানতে।শাড়ি কিনতে গিয়ে প্রতুল অনেক কিছু জেনেছে বন্ধুর কাছে।ছবিতা যেন ইতিহাসের ছাত্রী---কখন থেকে তৈরি হচ্ছে এই শাড়ি?

প্রতুল নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলে---সময়টা বোধহয় অষ্টাদশ শতকের কাছাকাছি।মুর্শিদাবাদের কাছেই জিয়াগঞ্জ।এখানের তাঁতিদের হাতেই এই শাড়ির সৃষ্টি।কিন্তু নামকরণ হয়েছে অন্য কারনে।জিয়াগঞ্জের পাশে বালুচর নামে একটা বাজার ছিল।এখানেই কেনাবেচা হত এই শাড়ি।বালুচরির নাম হয় এই বালুচর জায়গার নাম থেকেই।জিয়াগঞ্জের পার্শবর্তী এলাকা  বাহাদুরপুর,বেনিয়াপুকুর,রামডহর,রমনাপাড়া,আমডহর,বাগডহর প্রভৃতি এলাকার তাঁতশিল্পিরা এই শাড়ি তৈ্রি করে বালুচর বাজারে বিক্রি করতে আসত।কারো কারো মতে মুর্শিদকুলি খাঁ যখন ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন তখন বেগমদের জন্য নতুন শাড়ি তৈ্রির নির্দেশ দেন।তাই বালুচরি নামে খ্যাত।

কথায় আছে না রাজার বদান্যতা পেলে যে কোনো জিনিসের কদর বেড়ে যায়।মুর্শিদকুলি খাঁর প্রচেষ্টায় বালুচরির রমরমাও বেড়ে যায়।তুমি শুনলে অবাক হবে-এই শিল্পের শেষ বিখ্যাত  কারিগর দুবরাজ দাস নিজের নাম সই করতেন শাড়ির উপর।

ছবিতা বিস্ময়ে মুগ্ধ---তাই নাকি?

প্রতুল বলে---সত্যি অবিশ্বাস্য।


তারপর ঘটে যায় এক দুর্যোগ।গঙ্গার ভয়ংকর বন্যায় ভেসে যায় বালুচর ও পার্শবর্তী এলাকা।ভিটে মাটি হারিয়ে মানুষ আশ্রয় নেয় বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে।ধীরে ধীরে আবার বালুচরির ঐতিহ্য ফিরে আসে।আমরা তো জানতাম বিষ্ণুপুরেই বালুচরির আদিপত্তন।


বিষ্ণুপুরে শুরু হয় বালুচরির নতুন অধ্যায়।মল্লরাজাদের আনুকূল্যে ও সহযোগিতায় বালুচরির সম্মৃদ্ধি ও প্রসার ঘটে।নকশায় টেরাকোটা শিল্পের ছোঁয়া লাগে।রামায়ণ,মহাভারত,বিভিন্ন লোককথা সবকিছুই স্থান পায় বালুচরির চওড়া আঁচলে।ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য যেন শাড়ির পরতে পরতে।

তবে ব্রিটিশ জমানায় বালুচরির বাজার অনেকটা কমে যায়।সস্তার কলের কাপড়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ে।তাঁতিরা পড়ে মহাফাঁপরে।


শোনা যায় সুভো ঠাকুর ১৯৫৬ সালে তখনকার বিখ্যাত কারিগর অক্ষয় দাসকে জালা তাঁতের পরিবর্তে জ্যাকার্ড তাঁতের ব্যবহার শেখান।অক্ষয় দাস অজন্তা ইলোরার মোটিফ লাগিয়ে দেন বালুচরিতে।নতুনত্বের ছোঁয়ায় বালুচরি শিল্পের মরা গাঙে জোয়ার আসে।

ছবিতা এবার জানতে চায়---এবার বলো বালুচরি বানায় কিভাবে?  

প্রতুল কৌতুকপূ্র্ণ হাসি হেসে বলে---তুমি তো ৫ ফূট তিন ইঞ্চি।অথচ শাড়িটা ১৫ ফুট লম্বা।কত চওড়া দেখেছ?প্রায় ৪২ ইঞ্চি।লক্ষ্য করো বালুচরির অলংকরণে চারটে ভাগ-চিত্র,কল্কা,পাড় ও বুটি।

এখন তো বাজারে নানাধরনের বালুচরি দেখতে পাওয়া যায়।যেমন-সাধারণ বালুচরি,রঙ ঝলমলে মীনাকরি  বালুচরি,স্বর্ণচরি,রূপশালি ও মধুমালতি।এমনকি দ্রৌপদী বালুচরিও পাওয়া যায় যা টি.ভি সিরিয়াল মহাভারতের প্রভাব।


বালুচরি শাড়ি তৈরি এক জটিল প্রকৃ্যা।প্রথমে গুটি পোকা থেকে রেশম সংগ্রহ করা হয়,পরে তা সোডা ও গরম জলে সেদ্ধ করা হয়।অ্যাসিড জলে চুবিয়ে রাখা হয় সেই রেশম।তারপর দুদিক থেকে টেনে টান টান করে সুতো দিয়ে কাপড় বোনা হয়।শাড়ির নকশাগুলো কাগজে এঁকে পাঞ্চিং কার্ডের সাহায্যে শাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়।সত্যি কথা বলতে কি একটা শাড়ি বানাতে দুজন কারিগরের এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগে।আমাদের হাতে আসে শিল্পির পরিশ্রম আর অসাধারন দক্ষতার ফসল।


একটা কথা না বললেই নয়,বালুচরি কিন্তু অনেককাল আগেই বিখ্যাত।ইতিহাসে বলা আছে-১৯০০ সালে প্রখ্যাত শিল্পি  দুবরাজ দাস প্যারিসের বিশ্বমেলায় এই বালুচরির অসামান্য সৃষ্টি কৌশলের জন্য ডিপ্লোমা অফ অনার এবং স্বর্নপদকে ভূষিত হন।আবার ১৯০৬ সালে লন্ডন বিশ্বমেলায় প্রথম স্থান লাভ করেন।তাকে শ্বর্ণপদক আর সার্টিফিকেট অফ অনার প্রদান করা হয়।তখন দুবরাজ দাসের বয়স ৮৪ বছর।একজন শিল্পির কাছে এটা কম স্বীকৃ্তির নয়। প্রতুলের সুন্দর বর্ণনায় ছবিতা মুগ্ধ।একটা শাড়ির পেছনে যে এত ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়।


প্রতুল ছবিতাকে বলে---শাড়ির ইতিহাস তো শুনলে,এবার পরে দেখাও কেমন লাগছে দেখি?

ছবিতা শাড়িটা পরে আসে।অসাধারণ রঙের জৌলুসে ছবিতাকে আরো সুন্দরী দেখাচ্ছে। শাড়ির আঁচল জুড়ে নানান নকশা আর দ্রৌপদীর স্বয়ম্ভর সভার চিত্র।প্রতুল মুচকি হেসে বলে---বালুচরির সৌন্দর্য তুমি বাড়িয়েছ নাকি তোমার সৌন্দর্য বালুচরি বাড়িয়েছে?


ছবিতা বলে--- সেটা তুমিই বলো স্বামীবর। এবার একটা ছবি তুলবে না?

---একটা কেন, তুলব অসংখ্য। সঙ্গে কিছু সেলফি।

বালুচরি অঙ্গে ছবিতা আজ ইতিহাসের সাক্ষী।  



কবিতা

কবিতায় শৈত্য আরোহণ

 ~ অভিশ্রুতি রায়
শব্দবোধের উপর দিয়ে যেকোনো সেতু শুধুমাত্র আরোহণ এনে দেয়। এমন আরোহণ জুড়েই নেমে আসে  শীত। নেমে আসে রাগ, কথা, আলো ও কবিতা।  প্রত্যেকটা অক্ষরে কুয়াশা জমে। আসে পৌষ। আসে পার্বণ। এভাবেই কবিতা লেখা হয়। এভাবেই "পৌষের পাকা ফসলের ঘ্রাণ লেখা হয়"। প্রত্যেকটা স্বাদে, বিস্বাদে, দুধপুলিতে, পাটিসাপটায় "মৃদু কুয়াশার পথ ও পাতার শরীর " রেখে যায়। যেই পথে শুধু কলম নিয়ে হেঁটে চলা। হেঁটে চলা অজস্র অক্ষরে। "সমস্ত উত্তাপ বাঁধা আছে ওই চুড়োখোঁপায়"। শুধু অক্ষর জানে কুয়াশারও নিজস্ব রং থাকে। তাই এই বেঁধে বেঁধে চলা। তাই এত কবিতা। একের পর এক আরোহণ আর আরোহণ জুড়ে শীত।
তারপর"শিশির ডাকছে ঘাস ও পাতার সাথে তোমাকেও"
 

কবিতা

নবান্নের ঘ্রাণ

এখানে বিনম্র শীত

এখানে বিনম্র শীত

~ টিপলু বসু 


পুরোনো টাইপরাইটারে

পৌষের পাকা ফসলের

ঘ্রাণ লেখা হয়

চাবিগুলি ওঠানামা করে

হেসে ওঠে দুধপুলি পাটিসাপটা

নলেন গুড়ের পায়েস

সুস্বাদ যোগায় জলে ও পাথরে

ফসলের খেতের ভিতর

ধারালো কাস্তের আনাগোনা

এ-সবই শান্ত খিদের পাশে

বসে থাকা চড়াই পাখির মনে

দুঃখের কুয়াশার ছায়াপথে

অন্য এক বোধ রোপন করে

এক নবান্ন থেকে অপর নবান্নের দিকে

গড়িয়ে যায় উলের গোলা

উল ও কাঁটার সংযোগে

সেলাই হয় খয়েরি সোয়েটার।

এখানে বিনম্র শীত

এখানে বিনম্র শীত

এখানে বিনম্র শীত

~ মানিক সাহা


এখানে বিনম্র শীত -

মৃদু কুয়াশায় পথ ও পাতার শরীর

নিভন্ত রাতের পাশে 

অনায়াস রোদের কুসুম এসে পরে।

ঝরা পাতাদের দলে 

হেমন্তের চিঠি নিয়ে হেঁটে আসে গাঢ় পোস্টম্যান।

যাদের পোশাক থেকে 

সোনালি ধানের মৃদু গন্ধ পাওয়া যায়

তাদের স্বপ্নে ধিরে হেমন্তের রাত

পৌষের সকাল নিয়ে আসে।

কবিতা

কুয়াশা ব্যান্ডেজ

কুয়াশা ব্যান্ডেজ

কুয়াশা ব্যান্ডেজ

~ প্রবীর রায়


বাকি রইল ডিসেম্বর

আরও একটা মৃত্যুভয়                 

আরও একটা সুযোগ           

বছর পর্যালোচনা

সারারাত পতনের শব্দে

শিশির ডাকছে

ঘাস ও পাতার সাথে তোমাকেও                            
                                                                 
   
 

ডিসেম্বর

কুয়াশা ব্যান্ডেজ

কুয়াশা ব্যান্ডেজ

~ মনোজ দে


সুস্থতা তেমন অজুহাত নয়

কুয়াশার ভেতর তোমাকে পাঠানো শুভেচ্ছা যতখানি


গাছেরা তখনও ঘুমগ্ন, শীতল

রোদ আসার আগেই পৌঁছে যেতে চাই


দুয়ারে ছড়িয়ে শিউলি, মুঠো ভরতি তোমার আদল


এখনও সকালগুলো, অবিকল

তোমার যাওয়ার মত নিষ্প্রভ, সহজ    

    

কবিতা

শীত-শূণ্যতার ত্রিধা

শীত-শূণ্যতার ত্রিধা

শীত-শূণ্যতার ত্রিধা

~ সুমন মল্লিক



১

আজকাল লেখার ভেতর সুগন্ধি মেখে বসে থাকে কে?

এই শীতে, লেখার আগুনেই উষ্ণ হতে হতে দেখি

সে আর কেউ নয়, আজ থেকে ঠিক বারো বছর আগে

ভাবচক্রে ঘুরে ঘুরে তলিয়ে যাওয়া আমারই মতো কেউ৷ 


২

ভাঙা ঘুমের মাঝে ঘুঙুর বাজে৷

দেখি, শৃঙ্খল ভেঙে ছুটে আসা

অকল্পনীয় মায়া... অস্থির হই,

অথচ শীতের পশমের ভেতরে

স্থির শুয়ে থাকে আত্মার তৃপ্তি!

সমস্ত উত্তাপ বাঁধা আছে ওই

চুড়ো খোঁপায় – কোনদিনও তা

আর মুগ্ধান্ধ করবে না আমাকে৷


৩

কুয়াশার ভেতর কুয়াশা নিয়ে আশাকে ছিন্নভিন্ন করি

আবার এসেছে শীত, আমরা দুই মেরুতে পুড়ে মরি



মুকুর

শীত-শূণ্যতার ত্রিধা

শীত-শূণ্যতার ত্রিধা

~ দেবপ্রিয় হোড়



সারারাত ভুলোটা কেঁদে বেড়ায়;

শীতের রাতে দালান বাড়ির কাজের মেয়েটি

আর এঁটো-কাঁটা নিয়ে বের হয় না।

লক্ষ্মী পাগলী আর ওর অজ্ঞাতকুলশীল ছেলেটি,

কুড়োনো ডালপালা আর ভিক্ষার চালে খিদে মিটিয়ে,

ছেঁড়া কম্বল গায়ে আকাশপানে অভিযোগ জানায়।


অনেক রাত পর্যন্ত মন্দিরের পেছন থেকে

মন্টুমাতালদের চেঁচামেচি ভেসে আসে।

দালান বাড়ির কর্তাবাবুর সৌখীনগাড়ি

মাঝরাতে ফেরে বাড়ি ধুলো উড়িয়ে।

হাসি – কান্না

হাসি – কান্না

হাসি – কান্না

~ তৃণা কানুনগো


রাফিক মিয়াঁর দুর্দশা ভারী , ফসল হয়নি ক্ষেতে ,
দত্ত বাবু পরিবার নিয়ে, পিকনিক এ তে ছোটে ।
শশী দাদার রুগ্ন দশা, কোভিড বিপর্যয়ে ,
হকারি যে উঠল লাটে, জীবন সংশয় ।
ঐ দিকে দেখ মুখুজ্জ্যে দের , লাগল বাড়ি তে বিয়ে,
ভিয়েন সানাই সোনায় সোহাগা –পরিজন দের নিয়ে।
অস্তমিত প্রদীপ এর আলো, রমা দির ঘরে,
ভেজা মাটি আর কনকনে বায়ু – হিমেল নগ্ন ভোরে ।
রায় বাবুদের ব্যস্ততা ভারী, চললেন সবে গোয়া ,
বড়দিনেও কেউ পায়না আহার, বৃথা সব চাওয়া- পাওয়া।
এমন শিশুও আছে যাদের হয় নাকো নিউ ইয়ার,
পরে থাকা রুটি,  আর অবহেলা  -“নিদারুণ ফেলিয়ার” ।
ল্যাপটপ আর মোবাইল টা যে হল পুরাতন,
গায়ে জড়ান, চাদরেও ছেদ – অভাব অনটন।
পৌষ মাসে তে সেন বাড়ি তে হচ্ছে পিঠে- পুলি,
আধপেটা খাওয়া নয়ন গুলো কে- কেমন করে ভুলি?
কে যে ধনী, কেই বা গরিব,আজকে বুঝতে নারি,
বেঁচে থাকার আসল রসদ, মিথ্যেই খুঁজে ফিরি।


হাসি – কান্না

হাসি – কান্না

বিষয়ভিত্তিক গদ্য

নবান্ন ও পিঠেপুলি

~ সন্ধ্যা দত্ত  



হিমেল হাওয়ার সাথে গুটিগুটি পায়ে শীত আসে তার কেতাদুরস্ত বৈভব নিয়ে চুপিচুপি।ঘাসের ডগায় কুয়াশার ওড়না আর ওমমাখা সকাল বুঝিয়ে দেয় শীত দোরগোডায় হাজির।"শীতের হাওয়ায় লাগলো নাচন, লাগলো নাচন, আমলকীর ওই বনে বনে। "শীত এলেই সবার মনে খুশির নাচন শুরু হয়ে যায়। শীত মানেই উৎসব। নবান্ন, পিঠেপুলি, সংক্রান্তি।

নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রান। এটি হিন্দুদের একটি প্রাচীন উৎসব। যা আদিকাল থেকে চলে আসছে। নবান্ন মুলত পশ্চিমবঙ্গ ও বাঙলাদেশের একটি শস্য উৎসব। নবান্ন অর্থাৎ নতুন অন্ন। আমন ধান কাটার পর, সেই ধান থেকে তৈরি চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে পালিত হয় এই উৎসব। এই অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, ও কাককে উৎসর্গ করা হয়। কাকের মাধ্যমে এই খাদ্য মৃতের আত্ময় পৌঁছে যায়, এই ধারণার বশবর্তী হয়ে কাক কে খাওয়ানোর প্রথা চলে আসছে। গৃহকর্তা ও আত্মীয়-সব্জন কে নিয়ে বাড়ীর সকলে নতুন গুড় সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করে। 

বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বিভিন্ন গ্রামে ও পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমানে এখনও এই নবান্ন উৎসব পালিত হয়ে আসছে। 

বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ। পৌষ মাসে, পৌষ পার্বণ পালন করা হয় বিভিন্ন ধরনের পিঠেপুলির সমারোহে। খেজুর গুড় এর পায়েস ও পিঠেপুলি বাঙালির জীবনে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় নানারকমের পিঠে যেমন --পাটিসাপটা,মুগের পুলি, দুধপুলি, সরুচাকলি, গোকুল পিঠে, রসবডা,ক্ষীরের মালপোয়া, চিতৈ পিঠে, সাথে অতি অবশ্যই নলেন গুড় এর পায়েস। 

পৌষ মাস এলেই মন আকুলি বিকুলি করে নানারকমের পিঠে চাখবার জন্য। উনুনের ধারে গরম গরম পিঠে খাবার মজাই আলাদা। আবার শীতের কুসুমরোদে পিঠ দিয়ে বাসি খাওয়ার স্বাদ ও ভিন্ন মাত্রার ।

স্বভাবতই মা, মাসী, জানিনা, কাকীমাদের কথা মনে পড়ে যায়। কি অকৃত্রিম ভালোবাসায় পরমমমতায় সে সব তারা বানাতেন। যার স্বাদে মন-ময়ূরী নেচে উঠতো। 

এখন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হচ্ছে খাদ্য -মেলায় পিঠেপুলি উৎসব দিয়ে। যত ই আমরা ফাষ্ট ফুড খাই না কেন! পিঠেপুলি ও পায়েস ছাড়া বাঙালির পার্বণ জমে না। পিঠেপুলি মানেই মা, মাসীর আদরের কুয়াশায় জড়ানো, যার সুখ -স্পর্শে আজ ও মন উদাস হয়ে যায়। পিঠেপুলির মৌতাত এখন বন্দী স্মৃতির পাতায়। 

বিষয়ভিত্তিক গদ্য

সীমানা পেরিয়ে

সীমানা পেরিয়ে

সীমানা পেরিয়ে

~ সুনৃতা মাইতি



এখন শীত আসে কত কলরোল আর আমোদ নিয়ে। এই আপাত শৌখিন শীতবাবুটির আগমনার্থে হা পিত্যেশ করে বসে থাকা শহুরে মানুষজন পরিপাটি করে বিছিয়ে রাখেন উৎসবের নকশাকাটা আসন। মুখরিত হয়ে ওঠে এক একটি প্রাঙ্গন। পৌষপার্বণ কিংবা নবান্ন উৎসবের আগমনের বারতায় ছেয়ে যায় স্কুপবুক। ভালো লাগে ;আবার মন খারাপও হয়। এর চেয়েও কত কত সুন্দর ছবি ছিল যে । কতক গেছে হারিয়ে, কতক ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসছে গোচর মনাঙ্গনে। সেগুলো কাউকে দেখাতে পারিনি, শোনাতেও না। সারাদিনের যাবতীয় কাজ গুছিয়ে নিয়ে দুপুর শেষের দিকে যখনই একটু বসতে সুযোগ পাই ছবিগুলোর কথা ভাবি। একটু পরেই জানি ঝুপুস করে আলো মুছে যাবে। শীতের বেলা যে! তবে এই কলকাতার শীতকে আমার কোনওদিন শীত বলেই মনে হয়নি আদপে। গুনে গুনে কটা দিনই বা তার আনাগোনা! আমাদের ছোটবেলাকার সেই মফস্বলী উত্তুরে ঠান্ডার জম্পেশ কামড়ের কাছে কিছুই না। দুগ্গাপুজো শেষ না হতে হতেই তার গুটিগুটি পায়ে আগমন ঘটত। কালীপুজোতে রীতিমতো হিমেল বাতাসের দখলে থাকত জলশহরের অলিগলি। এখন সেখানে কেমন শীত পরে জানিনা। 


মনে হলো শীতকাল মোটের ওপর সর্বত্রই একটা জুবুথুবু জড় সময় বই তো নয়! জীবনের প্রান্তসীমায় যেন শীতকালের অবস্থান। শীতের বেলার চিরস্থায়ী অধিবাসী অতি প্রবীণ মানুষেরা রোমন্হন করেন তার জীবনের সরস ঋতুগুলির বদলের নানা পর্যায়। জীবনের তাপদগ্ধ গ্রীষ্মকালীন দিনগুলো মুছে দিয়ে সজল বর্ষা কিভাবে ছুঁইয়েছিল তার আদরিনী স্পর্শ; কিভাবেই বা বসন্ত এসেছিল তার জাগ্রত দ্বারে। এতটুকু লিখেই আমার ভারী বিরক্ত লাগতে শুরু করে। এমন কেতাবী ভাষা আমি কস্মিনকালেও লিখতে ভালোবাসিনা। তাই এরকম কেন লিখছি আমি জানিনা। তাই কলম কামড়ে টামড়ে এই লেখাটা আমি আমার স্বভাবের বিরূদ্ধে গিয়ে অগোছালোভাবে লিখব আর অবচেতনের হাতে ছেড়ে দেব বলেই শেষমেষ মনস্হ করলাম। পাঠকের বিচারে কি দাঁড়াবে দেখি।


জনপ্রিয় একটি কফির বিজ্ঞাপনে দেখেছি অসংখ্য মানুষের ভীড় থেকে বেছে নিয়ে বক্তা মাত্র গুটিকয়েক লোককেই সুযোগ দিচ্ছেন তার সাথে কফি পান করবার । এটা দেখলেই আমার মনে হয় আমি কাকে কাকে ডাকব কফি খেতে! বিশ্বাস করুন আমি থই পাইনা। আমার সাদামাটা মফস্বলী অতীত আমাকে চুজি হবার মত বিলাসী মন দেয়নি। তাই তালিকা দীর্ঘ.. অতি দীর্ঘ হতে থাকে।কাকে ছাড়ব! দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে কি মানুষ মুছে যায় সত্যিই? আউট অব সাইট; আউট অব মাইন্ড! মনে হয় না।


না, পিসিমনীকে বাদ দিতে পারব না ওই কফি পার্টি থেকে। বিজয়দশমীর পরের দিন কুচোঁকাচাদের একটি ঝুন্ড পাড়ার এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াত পেন্নামবার্তা প্রদান আর আশীর্বাদ আহরণের মত মহৎ কাজে। কারোর বাড়ি জুটত কুচো নিমকি আর বুঁদিয়া তো কারোর বাড়ি রসালো ঘুগনি। পাড়ার সর্বজনীন পিসিমনির বাড়িতে পাওয়া যেত ডালডাসুবাসিত ডালপুরি আর ছোট আলুর দম। সেখানে বেজায় ভীড়! কিন্তু পিসিমণি জনে জনে সযত্নে সবার পাতে বেড়ে দিতেন সেই মহার্ঘ্য বস্তুটি। বাদ পরত না কেউ। 

পাড়ার দোলন কত কিছু বানাত।সেই কুচো বয়সেই। কত কি যে তার হিসেব নেই! নববর্ষের শিল্পীত কার্ড, অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি, দূরবীক্ষণ যন্ত্র কিংবা বায়োস্কোপ বাক্স। বায়োস্কোপ বাক্স থেকে রশ্মি বেড়িয়ে সাদা পর্দায় ছবির বদল ঘটাত বারে বারে। আর কালিপুজার পাহাড়! দোলন ছিল আমাদের কালিপুজোর পাহাড়ের মূল রূপকার। সেই পাহাড়ের শৃঙ্গগুলো বরফাবৃত করা হত ব্লিচিং পাউডার দিয়ে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে হতো ঝুম চাষ, গড়ে উঠত পাহাড়ী জনপদ আর শ্বাপদ সংকুল অরণ্য। আঁকাবাকা পাহাড়ী রাস্তা সেজে উঠত আলোকিত লাইট পোস্ট, নিখু্ঁত রেলিং, পাহাড়ী ঝরণা আর রহস্যময় গুহায় । পাহাড়ের নিচের দিকে নীল জলাধার আর তার ওপর দোদ্যুলমান ব্রীজ। পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে একটি শিবের মুর্তি বসানো। শিবের মাথা থেকে একটি ফোয়ারার জন্ম হয়েছে। সবাই জানে ওটা মা গংগা। আমাদের পাহাড়ে সবারই কিছু না কিছু যোগদান আছে। কেউ মাঠ থেকে ঘাসের চাঙড় তুলে এনেছে, কেউ বা খাইবার পাসে ইন্ডিয়ার যুদ্ধ কামান বসিয়েছে ,কেউ বা বাড়ির লোকের চোখে ধুলো দিয়ে তুলে এনেছে সাদা পাউডার কিংবা ব্লিচিং পাউডারের প্যাকেট। দীপাবলির আলোকিত ভুবনে ওই পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে গর্বে ফুলে উঠত কচিদের বুক। ভরা শীতের মধ্যেই ক্ষুদ্র এই প্রাণীগুলোর পিকনিকের আসর বসে যেত কলিকাকিমার বাড়িতে। মুখ থেকে পিকনিকের কথা খসতে না খসতেই পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে জোগাড় হয়ে যেত চাল আর হাঁসের ডিম। পান্তিদিদা আর আলতাদিদারা মুখে পান গুঁজে তদারকি করতেন রান্নার। রান্না শেষ হলে আমাদের সাথে পাত পেড়ে খেতে বসত কলিকাকিমার কাজের বৌ জোসনা মাসীর মেয়েও। আমি বাপু এদের কাউকে কফিপার্টি থেকে বাদ দিতে পারব না। 


টুলুদের বাড়ির কারোর সাথে আমাদের বাড়ির কারোর কোনও আলাপ পরিচয় ছিলনা। থাকবে কি করে! টুলুরা তো থাকত কেরানী পাড়ায়। মামদের বাড়ির পাশে। মাঝেমধ্যে দাদু আমাকে মামদের বাড়ি নিয়ে যেতেন। সেখানে দুপুর আর বিকেল কাটিয়ে ফিরতাম। টুলুদের বাড়ি যেতাম মামের সঙ্গে । সেইখানেও হতো জমাটি খেলা আর পিকনিক। টুলুর মা ভারী যত্ন করে খাওয়াতেন সবাইকে। টুলুদের পাশেই ছিল বাচ্চুপিসির পেল্লায় তিনতলা বাড়ি। কিন্তু বাচ্চুপিসি সময় পেলেই দেওয়ালে ঘুঁটে দেন। বড়লোকের বউ এর এই বিচিত্র খেয়ালে আমাদের ভয়ানক আশ্চর্যবোধ হতো। তবে কি বাচ্চুপিসি দুখিনি দুয়োরাণী? আমার কথা শুনে মাম খুব হাসত। তা হবে কেন! বাচ্চুপিসি ওই ঘু্ঁটে বিক্রির পয়সায় আইসক্রিম খান নিত্য। ফিসফিস করে বলেছিল মাম। সত্যিই তো! বাচ্চুপিসি আমাদের আইসক্রিম খাওয়ানও বটে। কিন্তু এদিকে যে আমার লিস্টি সীমানা পার হয়ে যাচ্ছে ! 


আসলে না আমাদের পায়েও কোনও বেড়ি ছিলনা সীমানার। অচেনা মানুষকেও আপন করে নিতে জানত মফস্বলী সরলতা। শীত পড়ত জাঁকিয়ে; কিন্তু মানুষের মধ্যে বয়ে যেত না শৈত্য প্রবাহ। উষ্ণায়ন বেড়েছে পৃথিবীব্যাপী । ছোটবেলার মত শীত পড়েনা আর। শীত বোধহয় এখন মানুষের মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে। তার যাবতীয় নিস্পৃহ নিঃসঙ্গতা নিয়ে। এখন বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় দিনের আলো। কৃত্রিম আলোয় ছেয়ে যায় চারপাশ। এমনটাই বোধহয় হবার ছিল।

সেই দোলন আর ইহজগতে নেই। পিসিমনিও না। কারা কারা আছেন তাও জানিনা। আমি শুধু আশা করে আছি একদিন সবাইকে একসাথে পাব নিশ্চয়ই । কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে খিলখিল করে সবাই মিলে সেই হাসি হেসে উঠব আবার । যে হাসির পেছনে কোনও কারণ নেই।



পিঠে খেলে পেটে সয়

সীমানা পেরিয়ে

সীমানা পেরিয়ে

~ লিপি চক্রবর্তী



বাংলা প্রবাদ- টবাদ আমি মোটামুটি জানি। ভরা পেটে কিল চড় হজম করতে মা ঠাকুমারা বলে "পেটে খেলে পিঠে সয়"। কিন্তু রোগা মানুষ দেখলে তবে কেন বলে "আহারে! পেটে পিঠে একদম লেগে গিয়েছে"। পেটে খেয়েছে বলেই না পিঠে লেগেছে। তাতে দোষের কি যে হল, আজও বুঝিনি। ছোটবেলায় আচার চুরি করে খেলে, ধিঙ্গি মেয়ে হয়ে ভাইদের সঙ্গে গাছে চড়লে, সন্ধের সময় পড়তে না বসলে, গান শেখানোর বুড়ো মাস্টার মশাইকে দেখে পাশের বাড়ির পিসির কাছে পড়া করার অছিলায় পালালে (এগুলো কিন্তু ক্রিমিনাল অফেন্স নয়) মা হুমকি দিত, পিঠে দু ঘা পড়লেই সব বদমাইশি ঘুচে যাবে। পেটে পেটে তো বিদ্যার জাহাজ এক এক জন। এখানেও সেই পিঠে আর পেটের যুগলবন্দি। একে অন্যের সঙ্গে চালের গুঁড়ো আর নলেন গুড়ের পাক করা নারকেলের মতোই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত পিষ্টকাকারে।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষে লিখছেন "পিঠা হলো চালের গুঁড়া, ডালবাটা, গুড়, নারকেল দিয়া তৈরি মিষ্টান্ন বিশেষ।" আসলে পিঠে বস্তুটাকে মিষ্টি হিসেবেই ধরে নেওয়া হত একটা সময় পর্যন্ত। পিঠেপুলি ব্যাপারটা যে মিষ্টির থেকে আলাদা বা অন্যরকম কিছু খাদ্য, সেটা এখন উৎসব পালনের ঘটা দেখে উপলদ্ধি হয়। 

পিঠে শব্দটা এসেছে সংস্কৃত পিষ্টক শব্দ থেকে। এই পিষ্টক শব্দটার মধ্যে রয়েছে পিষ্ট শব্দটি। যার অর্থ চূর্ণ বা পেষা কোনো বস্তু। যেহেতু চালের গুঁড়া পিঠের শিরদাঁড়া আর গুড়, নারকেল, দুধ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপকরণ গুলি হল পিঠের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, তাই শীত কালের এই অতি উপাদেয় সুখাদ্যটি পিষ্টক নামে পরিচিত। যদিও শুধু সুখাদ্য হিসেবে নয়, বাঙালির বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান কিংবা বিয়েতেও পিঠে বানানোর রীতি আছে।


ধান থেকে চালের উৎপত্তি। তাই নতুন চাল বাঙালির ঘরে ওঠার সময় হয় নবান্ন উৎসব। এই উৎসবে নবান্ন- পিঠে বানানোর নিয়ম। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে এই সময় লক্ষ্মী পুজো হয়। ক্ষেত্র দেবতার পুজোর নৈবেদ্য নতুন ধানের চিতই পিঠে আর লক্ষ্মী ঠাকুরের অপরিহার্য নৈবেদ্য হল পুলিপিঠে। লোককথার ছড়ায় আছে, নয়া ধানের চিড়ামুড়ি পুলিপিঠা করে/ মা লক্ষ্মীকে পূজে আরো পরতি ঘরে ঘরে।

বাংলার ঘরে ঘরে যেহেতু ধান থেকে উৎপাদিত চালই একমাত্র খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়, সেই কারণেই চালের গুঁড়ো পিঠে তৈরির প্রধান উপকরণ। যদিও বাঙালির ইতিহাসে পিষ্টক বা পিঠের অপরিহার্য হয়ে ওঠার তেমন কোনো বিবরণ নথিবদ্ধ নেই। 


তবুও পিঠের বয়েস নেহাত কম নয়। সংস্কৃত সাহিত্যে পিষ্টক শব্দটির উল্লেখ আছে। আর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি কাব্যে এবং ময়মনসিংহ গীতিকার কাজলরেখা আখ্যানের সূত্র ধরে প্রায় পাঁচশো বছরের পিঠের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।

কাজলরেখার পিঠে তৈরির বর্ণনা এই রকম--- নানা জাতি পিঠা করে গন্ধে আমোদিত/ চন্দ্রপুলি করে কন্যা চন্দ্রের আকিরত/ চই চপরি পোয়া সুরস রসাল/ তা দিয়া সাজাইল কন্যা সুবর্ণের থাল/ ক্ষীরপুলি করে কন্যা ক্ষীরেতে ভরিয়া/ রসাল করিল তায় চিনির ভাজ দিয়া।


বরিশাল নিবাসী বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলে পাওয়া যাচ্ছে নানান পিঠের কথা--- মিষ্টান্ন অনেক রান্ধে নানাবিধ রস/ দুই তিন প্রকারের পিষ্টক পায়েস/ দুগ্ধে পিঠা ভালো মতো রান্ধে ততক্ষণ/ রন্ধন করিয়া হইল হরসিত মন। 

বর্তমান ব্যস্ত জীবনেও কিন্তু পিঠে পুলি পার্বন হয়। গ্রাম দেশে ঘরে ঘরে পৌষ ডাকা হয় পৌষ সংক্রান্তির ভোরে। দিনভর পিঠেপুলি তৈরি হয়। আর ব্যস্ততম শহরে বসে পিঠের মেলা। সেখানে লাইন দিয়ে পিঠে কেনার জন্য সুবেশ- সুবেশিনীরা ভিড় করেন। সেখানে অনেক প্রকার সাবেকী কিংবা ফিউশন পিঠের সম্ভার থরে থরে সাজানো দেখেই মন ভালো আর জিভে জল। 


পৌষ পার্বন বলতেই ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মকর সংক্রান্তির দিন সারাদিন ধরে কত রকমের পিঠে তৈরি হত বাড়িতে। তখন কত লোক ছিল। ঠাম্মা, মা, কাকিমা, পিসি, ছোটঠাম্মা। বাড়ির ছেলেরা বাটি ভর্তি দুধপুলি হাপুস হুপুস করে খেত। ছোটরা তো পাটিসাপটা বানানোর সময় থেকেই কেঁদে কঁকিয়ে আদায় করে নিত। যখন পাত পেরে রাতে খাওয়ার সময় হত, তখন তাদের পেট ফুলে জয়ঢাক। ঠাম্মা বলতো, বাসী পিঠের নাকি স্বাদই আলাদা। আরো অমৃত। ছোটবেলায় অবশ্য টাটকা বাসী সবই আমাদের অমৃত মনে হত।


যাই হোক, যে মিষ্টান্নটি পাঁচশো বছর ধরে বাঙালির পুজো পার্বনে, রান্নাঘরে তো বটেই কাব্য কাহিনীতেও ঠাঁই পেয়েছে তার জনপ্রিয়তা যে ক্রমাগত বাড়বে সেটা নিশ্চিত। তাই পিঠেটা সময় মতো উপযুক্ত মান দিয়ে, ভালোবেসে খেতে পারলে পেট রোগা বাঙালির পেটে যে সইবে সে কথা বলা যেতেই পারে।

বিষয়ভিত্তিক গদ্য

সোয়েটারের বুকপকেটে শীত

সোয়েটারের বুকপকেটে শীত

সোয়েটারের বুকপকেটে শীত

~ নীলাদ্রি দেব 



শীত শব্দের সাথেই নেমে আসে অদ্ভুত এক স্তব্ধতা। এ স্তব্ধতাকে শুধু কথায়/ শব্দে প্রকাশ করা কঠিন। শীতের এক ধরনের টান আছে। অনুভবে তা প্রকট। অনেকটা স্প্রে পেইন্ট এর মতো ধূসর। মাঝে কোনও অস্পষ্ট জানালা। যে জানালা খুলে দিলেই জোয়ারের জল ঢুকে যায় মশারির ভেতর। পাশবালিশ, কম্বল ছেড়ে সোজা গলি। গলি পেরিয়ে নির্জন হাইরোড। অজানা গানের ভেতর চেনা সুর। পাশে বাগান। স্তরে স্তরে শীতে জমে আছে। দূরে সরু নদী। নদীধারে, নৌকোর ঘাটে, সাঁকোর ওপর নামতার ঘনত্ব বাড়ছে। দূর বলে আদৌ কি কিছু হয়... এমন প্রশ্নের পাশে বসে কেউ চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন শীত বিষয়ক রচনায়। এদিকে, ভোর আর শীতভোরের মাঝে থাকা অজস্ৰ মাইলফলক, প্রায় বুজে থাকা চোখেও স্পষ্ট। স্ট্রীটলাইট জ্বলে আছে, তবু এত নির্মম! মাঝে মাঝে কিছু অপ্রত্যাশিত চিৎকার থেকে অবস্থান বুঝে নিতে হয়। এরপরও... শীত তো শীতের মতোই। সোয়েটার বুনতে বুনতে উলকাটা তুলে রেখেছেন বয়স্কা রমণী। আর উলবল গড়িয়ে গেছে স্মৃতি বরাবর। তুলে নিতে চাইলে, গুটিয়ে নিতে চাইলে অনন্ত এক জার্নির দিকে পা বাড়াতে হবে। পা বাড়ালেই রহস্য আর জীবনের টুকরো বাসস্টপ. গন্তব্য এক/ আলাদা. হেঁটে তো যেতেই হবে। ছুঁয়েও... দেখুন, এর মধ্যেই গেঁথে আছে জীবনের উপকরণ। গেঁথে আছে উদযাপনের খসড়া হিসেব। ঐ যে হেমন্তের মাঠ। ফেলে আসা মাঠ। নতুন ফসল। মাঠের ভেতর, পৃথিবীর হাঁ মুখের নিচে, মাটির চাদরের নিচে স্তরে স্তরে সাজানো শস্যের গোলা। ইঁদুরের ভরা সংসার। এদের মাঝেও হানা দিচ্ছে খাদ্যাভাব। আর যারা শীতঘুম দেবে বলে নিচে, আরও নিচে নেমে আসছে, ওদের ফেলে আসা ত্বক কুড়িয়ে রাখছেন কেউ, অভ্যাসবশত। এসব তো হামেশাই ঘটে। এত ছবি, তবু ছবি হয়ে ওঠে কিছু কিছু স্বাদ। স্বাদবদল আর স্বাদকোরকের মাঝে ঢুকে যাচ্ছে ব্যবধানের ইঙ্গিত।


এসবকে পাশে রেখে তবু নবান্ন হয়। পিঠেপুলি। নতুন শস্যের শ্বাস। ঢেঁকি, চেনা-অচেনা পেষাইসামগ্রী, সাবেকি সম্পর্ক। এসবের মত আমরাও ওম খুঁজি। সমস্ত নতুন যেন জড়িয়ে ধরে। স্বাদ থেকে সময়বদল... আপেক্ষিক ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে সেমিনার শেষ হলে বাকি থাকে জোনাকি মিছিল। একটা একাত্মতার গল্প। যৌথ যাপনের রোজনামচা শুরু হয়। পথের শুরু/ শেষ নিয়ে যে আড্ডা-জটলা, তার মাঝেই জ্বলে ওঠে না-নেভা আগুন। ধিকধিক কয়লার বাতি, তাপের আদান প্রদান। সেই সুর বয়ে নিয়ে যায় অচেনা পাখির ডাক। দূরে, আরও দূরে। পথের পাশে খেজুরগাছের সারি। ভোরে খেজুরের মধু। সমস্ত স্বরের পাশে কামরাঙা গাছ। বার্ড ভিউ ইমেজ। তুমি পালাতে পারবে না, পথিক. তুমি আসলে তোমার চরিত্রে আছো। মঞ্চ, মোহ, মায়ার সমান্তরালে পৌষ এসেছে। পূর্বাহ্ন, তা সে ফেলে আসা ঝরাপাতা হোক, কিংবা ভোরের শব্দহীন হেঁটে চলা, ঘোরে আটকে গেছো। 


ঘোর কাটিও না, প্রভু! দিনের প্রথম ট্রেন, দোতলা বাসের উপর কালি খসে যাওয়া ভেজা চিঠি। স্বপ্নটা ভাঙতে দিও না। এসব আঁকড়েই তো...




শীত শূণ্য রূপকথা

সোয়েটারের বুকপকেটে শীত

সোয়েটারের বুকপকেটে শীত

 ~ সুমনা ঘোষ দস্তিদার 



কেমন সোনা সোনা রঙ, হাওয়া ছুঁয়ে গেলে লাজুক প্রেমিকার মত গাল নামিয়ে যেন নূপুরের আওয়াজ তুলে ছুট লাগায়। অনিচ্ছুক ধানের শরীর মুচড়ে ধরে নিষ্ঠুর হাত কেটে নিয়ে টেনে ঘরে তোলে। সীতার হরণ চিহ্নের অলঙ্কারের মত কিছু সোনালি ধান ছড়িয়ে রয় পথে।


কাছে আসে উৎসবের মরশুম। লেপ্টে থাকা পুরুষের বুক ছেড়ে সে উৎসবেরই প্রস্তুতিতে মাতে মেয়ে। বাহারি শাড়িতে পেঁচিয়ে ধরা যুবতী শরীর ঢেঁকিতে পা রেখে তালে তালে ওঠে নামে। কখনও হামানদিস্তা খামচে ধরে রেশমি চুড়ির হাত। আস্তচাল গুঁড়িয়ে যেতে থাকে আঘাতে আঘাতে। জুঁই ফুলের মত ছড়িয়ে থাকা কোড়ানো নারকেল পেটে ঠেসে তৈরি হয় হরেক রকম পৌষের পিঠেপুলি। কামড়ে গুড় গড়িয়ে ঠোঁট মাখামাখি। পৌষের নবান্নের সুঘ্রাণ কচি মুখের হাসির মত নরম, বাতাসে ব সে নতুন চাল আর গুড়ের গন্ধ ছড়ায়। এই হলুদ রোদ্দুর আর হিমেল বাতাস কি কিছু বলে যায় কানে কানে? সে কি বলে যায়, এল যে শীতের বেলা? আর কিছুটা ক্ষণ, শুরু হবে পাতা ঝরার দিন। বিবর্ণ স্মৃতির মত পাতারাও রঙ হারিয়ে খসে উড়তে উড়তে মাটি ছোঁবে। সে শীত শূন্য মাঠের গল্প শোনাবে, কুয়াশা মাখা ঝাপসা রাতে মন খারাপের গল্প বুনবে?গভীর থেকে গভীরতর হবে পর্ণমোচীর দেহ ক্ষত? তবে পৌষ মানে কি এই শূন্যতার, রিক্ততার, হারিয়ে যাওয়ারই পূর্বাহ্ন?


যতই থাক সে মুছে যাবার কথা, কিছু রঙ হীনতার কথা, তবুও তো কিছু কথা থেকে গেছে তোমার আমার! পদ্ম পাতায় শিশিরের মত কিছু টলমলে প্রেমও। হিমঝুরি ঝরে যে পথে, কুয়াশা মাখে যে পথ, রাতে পথবাতির আবছা আলোয় পাশাপাশি হেঁটে যাবার কথা আছে তো সে পথেই! কিছু গান, কিছু শব্দ আজও তো থেমে আছে ওই আকাশ প্রদীপের আলোয়। দেব মহলের বন্ধ দুয়ার খুলে গেলে জীবনের গান ওঠে, উত্তরায়ণের পথে এগিয়ে চলা মানেই তো জেগে ওঠার ডাক। পৌষের শেষ প্রহরেও জীবনে জীবনে জুড়ে যাক শিশির মাখা, মিঠে রোদের কিছু রূপকথারা।

অনুগল্প

ওম্

বাঁধন

বাঁধন

~ নিবেদিতা চট্টরাজ 



কুয়াশায় দেখা যাচ্ছে না চারিদিক।দোকান বন্ধ করে আসতে আজ একটু দেরিই হয়ে গেল সোমনাথের।রাস্তার ধারে কুপি জ্বেলে যে বুড়ী ভাপা পিঠা ভাজছিল; সে তার পসরা গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত।আজ বড্ড শীত পড়েছে। পৌষ- পার্বণ বলে কি?

সকাল থেকে মন মেজাজের বারোটা বেজে আছে। দীপা দিন দিন কেমন যেন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। সন্তান না হওয়ার জন্য রোজ দোষারোপ করে যাচ্ছে সোমনাথকে।শহরতলীর রাস্তায় জমাট কুয়াশা ছুঁয়ে যাচ্ছে সোমনাথের শরীরে ও মনে। সাইকেল চালিয়ে আসতে গিয়ে হঠাৎ রাস্তার পাশে কুকুরদের জটলার দিকে চোখ গেল। একটা কাপড়ের পুঁটলিকে ঘিরে ওদের জটলা না??


আজ পৌষপার্বণ বলে সকাল থেকে শাশুড়ীর সাথে পিঠে পুলি তৈরির ব্যস্ততা ছিল। সারা উঠোন জুড়ে চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা দিতে হবে; শাশুড়ীর নির্দেশ। অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে দীপা; তবু গঞ্জনা!! দীপার ননদ তার ছেলে মেয়েকে নিয়ে পিঠেপুলির নেমন্তন্ন খেতে এসেছিল।দীপার শাশুড়ী আলপনা দেওয়া উঠোনে পিঠে ভাজতে ভাজতে মকর সংক্রান্তির পৌরানিক গল্পগুলো বলছিলেন। নানানরকম... নানা মতের গল্প আছে নাকি মকর সংক্রান্তির।দীপা মন দিয়ে শুনছিল।শাশুড়ী বলে চলছিলেন... সূর্যদেব এই দিনটি মকর রাশির অধিপতি পুত্র শনিদেবের বাড়িতে একমাসের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলেন।তাই এই দিনটিকে বাবা-ছেলের সম্পর্কের একটি বিশেষ দিন হিসেবেও ধরা হয়ে থাকে।

গল্পটি বলার পর শাশুড়ীর শুরু হলো আক্ষেপ যে সোমনাথের কোনো সন্তান হলো না! বংশে বাতি দেবার মতো কেউ রইলো না!! ছেলে -মেয়ে আলাদা নয় দীপার কাছে। কেন!! তার ননদ মলির ছেলে মেয়েদের কি দীপা নিজের সন্তান বলে ভাবে না? সন্তান কি শুধু নিজের গর্ভজাতই হতে হবে???


রাত এগারোটা। দীপার অস্থিরতা বাড়ছে।এখনো বাড়ি ফিরলো না সোমনাথ......... জানলা ফাঁক করতেই জমাট কুয়াশা। কেন যে সকাল সকাল কতোগুলো কড়া কথা শোনালো সোমনাথকে---- সন্তানের আকাঙ্ক্ষা তো দুজনেরই----সেই কষ্ট ভাগ করে নেয় দুজনে।তবু কেন মনে হয় নিজের সন্তানহীনতার জন্য দায়ী সোমনাথ?? আর তা মনে হলেই কথার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে সোমনাথকে।

দরজার কড়া নড়ে ওঠায় চিন্তার ব্যাঘাত ঘটলো দীপার।সোমনাথের চাপা উত্তেজিত গলা---"দরজা খোলো..."। একি --- সোমনাথের হাতে কাপড়ে জড়ানো পুঁটলিতে কি একটা নড়েচড়ে উঠছে না? যে কান্নার আওয়াজ শোনার জন্য সবসময় ছটফট করে-- তেমন আওয়াজ আসছে না কাপড়ে জড়ানো পুঁটলিটা থেকে? 

কাপড়ে জড়ানো নড়েচড়ে ওঠা পুঁটলিটা বাড়িয়ে দিল সোমনাথ দীপার দিকে--- সোমনাথের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকালো দীপা; সেখানে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ও আনন্দ – বিস্ময় খেলা করছে। বাইরের জমাট কুয়াশা কি হালকা হতে শুরু হলো!! মকর সংক্রান্তির চাঁদ কি কুয়াশার চাদর সরিয়ে আকাশে উঁকি দিচ্ছে?

একবছরের শিশু পুত্রকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে দীপা। এক অদ্ভুত ওম্ ঘিরে ধরেছে শরীর জুড়ে।আজ আবার মকর সংক্রান্তি।প্রতি বছরের মতো এবারও সকাল সকাল চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা দিয়ে স্নান করে ঘরে এসে ছেলের কাছে শুয়েছে দীপা। শাশুড়ী মা প্রথম প্রথম ঋজুকে মেনে নিতে না পারলেও এখন বেশ আদর করেন নাতিকে। রাস্তার ধারে কুড়িয়ে পাওয়া একটা বাচ্চাকে সোমনাথ ও দীপার নিজের সন্তানের মতো বুকে টেনে নেওয়া উনি মোটেও ভালো চোখে দেখেননি!!! কিন্তু ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুটির কাছে হার মেনে গেছে ওনার সব অহংকার। নাতি বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে ঠাকুমার কাছে।ওনার বংশধরের আক্ষেপ উনি মিটিয়ে নিয়েছেন ঋজুকে পেয়ে। ছোট্ট শিশুর কাছে হার মেনে গেছে ওনার সকল সংস্কার।


গতবারের মতো এবারও বাইরে ঘন কুয়াশা। সূর্য মুখ লুকিয়েছে কুয়াশার চাদরে। ঘন কুয়াশার একটা গন্ধ আছে। জানলা খুললেই সেই গন্ধটা এসে নাকে লাগছে।

ঘোর কাটলো সোমনাথের কথায় ----"কি ঠিক করলে দীপা? তোমার এত বছরের স্বপ্ন; পূজো; মানত সফল করে মা হতে চলেছ তুমি ---- তোমার আমার সন্তান ----কিন্তু দুটো বাচ্চাকে ভালো ভাবে বড়ো করা, মানুষ করা আজকের দিনে আমার একার আয়ের ওপর অসম্ভব। বেশ কিছুদিন থেকেই তো বলছি তোমায়; এবার একটা কিছু ডিসিশন নিতে হবে আমাদের। “দীপা উত্তর দেয় না। শুধু আরো জোরে বুকে চেপে ধরে ঋজুকে। বাইরের কুয়াশা তখন আরো ঘন হচ্ছে।

অ্যাবরশান করিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরকে বিছানায় এলিয়ে দিল দীপা।হ্যাঁ; ওদের অর্থের টানাটানি। সন্তানকে পৃথিবীতে এনে তাকে কষ্টের মুখে ঠেলে দিতে পারবে না।পারবে না ঋজুকে অযত্ন করতে। লকডাউনের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাকে নিয়ে জেরবার সোমনাথের কাঁধেও আর বাড়িয়ে দিতে পারবে না কোনো বোঝা।


ভীষণ শীতে শরীর কাঁপছে দীপার।পাশ থেকে দীপার বুকে মাথা গুঁজে দিল একটা ছোট্ট শরীর---ঋজু----একটা অদ্ভুত নরম ওম্ আবার জড়িয়ে এল দীপার সমস্ত শরীর জুড়ে।বাইরে তখন কুয়াশা কেটে গিয়ে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে। সোমনাথ এসে দাঁড়ালো ওদের মাথার কাছে।দুজনের চোখ একসাথে ঘুমন্ত ঋজুর মুখের দিকে। মকর সংক্রান্তির পুণ্য তিথিতে কি পিতাপুত্রের সম্পর্কের বুনিয়াদ আরো দৃঢ় হলো?


সোমনাথের মুখ এক অদ্ভুত আলোতে মাখামাখি আর ঋজুর নরম শরীরে উষ্ণতার ওম্। বাইরের কুয়াশা কেটে পড়ন্ত বিকেলে দেখা যাচ্ছে সূর্যকে। মকর সংক্রান্তির সূর্যদেব এখন পরিতৃপ্ত হয়ে বিশ্রাম নেবেন।


বাঁধন

বাঁধন

বাঁধন

~ সঞ্জয় কুমার নাগ



‌ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অর্কপ্রভ। একেবারে রিল্যাক্সড মুডে। নিউটাউন হাইলাইটস টাওয়ার্সের বারোতলার ফ্ল্যাট। ক'দিন হলো বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। ঠোঁটে একখানা জ্বলন্ত সিগারেট।শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, রাতে খাবার পর ওর বরাদ্দ একখানা সিগারেট।এ ওর অনেক দিনের অভ্যেস। সিগারেটে টান দিতে দিতে বাবা-মায়ের কথা ভাবছিলো অর্ক। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট করেছে দু'হাজার এগারো তে।পড়া শেষ করেই তেল কোম্পানিতে চাকরি।মোটা মাইনে। বাবা-মা আর দেরি করেন নি। একমাত্র সন্তানের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন ওর পছন্দ করা মেয়ের সাথেই। দু'হাজার চোদ্দয় গুবলু এ'ল। সেবারই ও বড় কোম্পানি তে অফার পে'ল। অর্কপ্রভ আর অলিভিয়া ,দু'জনেই মনে মনে বিশ্বাস করে-গুবলুর বরাতেই অর্কর এই উন্নতি। তারপর ষোলো তে নিজের দামী ঝাঁ চকচকে হন্ডা ফোর হুইলার।আর আঠেরো তে এই ফ্ল্যাট।


বছরে একবার অন্তত কোচবিহারে নিজের বাড়িতে অর্ক যাবেই। সেখানে বাবা-মা থাকেন।পাড়া-পড়শি নিয়ে ভালোই আছেন ওঁরা।বাড়িটা কোচবিহার শহর থেকে একটু দূরে ঘুঘুমারি তে। বাড়ির কাছেই বয়ে চলেছে তোর্সা। প্রচন্ড গরমে নদীর হাওয়া তে শরীর জুড়িয়ে যায়। কোলকাতায় বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ার সময় কলেজেই অলির সাথে পরিচয়।অলি মানে অলিভিয়া সেন।ওর স্ত্রী।

অর্ক আর অলির কনজুগাল লাইফ ঈর্ষা করার মতো।এত কম বয়সে ওদের ম্যাচিওরিটি দেখলে অবাক হতে হয়।অলির চাকরি একটা কার কোম্পানি তে।একই সাথে বি.এম. কমপ্লিট করেছে দু'জনে।তবে অর্ক একটা বোমা।অনেকের চাইতেই ঢের ভালো রেজাল্ট ওর। কোলকাতায় বাপের বাড়ি থাকায় বেশ খানিকটা সুবিধে হয়েছিল অলির। সেক্টর ফাইভে মায়ের কাছে গুবলুকে জমা করে অফিসে। আবার ফেরার পথে ওকে নিয়ে বাড়ি। ‌এদিকে অর্কর বাবা-মা সারাবছর হা-পিত্যেশ করে বসে থাকেন, পুজোর সময় ছেলে বাড়িতে আসবে।সত্যি বলতে কি, অলিভিয়া শহুরে মেয়ে হয়েও গাঁয়ে এসে ক'টা দিন বেশ আনন্দ করে। কিন্তু এবার আর তা হলো কই? লক্ ডাউনে কোম্পানি গুলোর ক্ষতি হয়েছে।তাই অর্ক-অলি, কেউই ছুটি পায়নি পুজোয়। এখন আবার ছেলের চেয়ে নাতির টান বেশী।আসলের চেয়ে সুদের মায়া যেমন। মোবাইলে ভিডিও কলে কি আর দাদু-ঠাম্মার মন ভরে? তাই অর্কর বাবা মনমরা।মা একেবারে মুষড়ে পড়েছেন। এতটা দিন নাতি-ছেলে-বৌমাকে দেখতে পাননি।অর্ক বলেছিল-জানুয়ারী তে দিন পাঁচেকের ছুটি পাওয়া গেলেও যেতে পারে।


এবার শীতের বাজারে নতুন নলেনগুড় উঠেছে। গাঁয়ের খাঁটি খেজুরের রস দিয়ে তৈরি।সারা বাজার গুড়ের গন্ধে ম ম করছে।অনলবাবু বাজার থেকে গুড় আর চালের গুঁড়ো নিয়ে এলেন।তা দেখে তেলেবেগুনে অবস্থা অর্কর মায়ের।আসল লোকের পাত্তা নেই, উনি বাজার থেকে গুড় নিয়ে এলেন!!?পালে পালে ছাত্র-ছাত্রীদের আমাকে পিঠে বানিয়ে খাওয়াতে হবে?? অর্কর বাবা শিক্ষক মানুষ। ছাত্র অন্ত প্রাণ।গিন্নিকে ঠান্ডা করতে বললেন-আহা, রাগ করো কেন? সারাবছর ওরাই তো আমাদের দেখেশুনে রাখে। খোঁজখবর করে।


পৌষ পার্বণ কাকে বলে, তা গাঁয়ে না এলে বোঝা যায় না। একেবারে দুঃস্থ পরিবারও এই দিনটিকে পালন করতে চেষ্টা করে।অনলবাবু রোদে পিঠ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। কাজের মেয়ে শেফালী বারান্দায় পেপার পেতে নাড়কেল কুড়ছে। রান্নাঘরে গিন্নি প্রস্তুতি নিচ্ছেন পিঠে-পায়েসের।মুখ অসম্ভব ভার। গেটে কলিং বেলের আওয়াজ। বিরক্ত হয়ে সুমিত্রা গজ্ গজ্ করতে করতে এগিয়ে গেলেন।দরজা খুলতেই থ!!!গুবলু দৌড়ে জড়িয়ে ধরে বললো-আম্মা.........।

অনুগল্প

পৌষের ঘ্রাণে নীরবতা

~ মৌসুমী মজুমদার



পূজো শেষ হতেই কেমন একটা হিমেল ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শ। এবারের পূজোটা প্রতি বছরের ন্যায় আশ্বিন মাসে না হয়ে কার্তিক মাসে হয়েছে। দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজো,কালীপূজো, ভাইফোঁটা পার হতেই পরিবেশে একটা ঠাণ্ডার বাতাবরণ__হেমন্তকাল ঋতু বদলের পালা চলছে। এবছরটা কোনো কিছুই সেভাবে উপভোগ করার সুযোগ হলো না। গৃহবন্দী দশায় ঘরে বসে ভার্চুয়ালি আনন্দে সামিল হওয়া ছাড়া। এমনকি বিজয়ার কোলাকুলি, প্রণাম আশীর্বাদ সবই হলো অন লাইনে। ভাই ফোঁটায় বোনের মন্ত্র উচ্চারণ মঙ্গল কামনা প্রণাম আশীর্বাদ সবই মোবাইলের স্ক্রিনে। মিষ্টির শুধু দৃষ্টি ভোজন হলো স্বাদ আস্বাদন থেকে বিরত।সব কিছু ঠিক থাকলেও এবার কোনো আনন্দে কি সামিল হতে পারতো ঋতম?


সন্ধ্যায় বারান্দায় ইজিচেয়ারটায় বসে বাবার স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করে। বাবার প্রাণ খোলা হাসি, কথাবার্তা, বাবার সঙ্গে কাটানো সময়গুলো ঘুরে ফিরে মনের কোণে বারবার উঁকি দেয়। নানা ভাবনার দোলাচালে____ দেখতে দেখতে বাবাকে হারানোর এক বছর হতে চলল‌। কিভাবে যে দিন কেটে যায়। এযেন সেদিনের কথা__

বাবু আজও লেপ কম্বলগুলো রোদে দেবার ব্যবস্থা করলি না? ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে পৌষ মাস চলে এলো। মায়ের কথায় ঘোর কাটে ঋতমের। 


হু__কালকে দিয়ে দেব, বলে মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপটা উঠিয়ে নিয়ে চুমুক দেয়। 

কি এতো ভাবছিস?সব কাজ ঠিক মতো হয়ে যাবে চিন্তা করিস না।

সেসব কথা নয়__একটা বছর কিভাবে কেটে গেল তাই না মা?


হ্যাঁ রে। যাকে ছাড়া একদিনও কাটাইনি, সেই মানুষটি হঠাৎ আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গিয়ে মনের মধ্যে কি রকম এক অদ্ভুত শূন্যতার সৃষ্টি করে দিয়েছে। বাবার কথা বলতে গেলেই মানসী দেবীর চোখ ছলছল করে ওঠে।

গত বছর হঠাৎ স্ট্রোকে ওদের বাবার মৃত্যুটা কেউই মনে নিতে পারেনি। সুস্থ সবল হেঁটে চলে বেড়ানো মানুষটি বিনা নোটিশে এভাবে ছুটি নিয়ে নেবে__ সকলের কাছেই কল্পনার বাইরে।বাবার অনুপস্থিতিটা ভীষণ ভাবে প্রত্যেকের মনে আঘাত হেনেছে। পৈত্রিক বাড়িতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে অরিজিৎ বাবুর নার্সিং হোমে ভর্তির খবরে, ভাই বোনদের এক জায়গায় জড়ো করে তিনি যে আর ফিরলেন না ঐ মুহুর্তে কেউ সেটা মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। বাবার কাজকর্ম, জোরে চেঁচিয়ে কথাবলা, হাঁটাহাঁটি, ছেলে মেয়ে নাতি_নাতনীদের চিন্তা এসব নানা কথায় সকলের মনই ভারাক্রান্ত___ শীতের শুরুতেই বাবার ঘুরতে যাওয়া, খাওয়ার প্ল্যান, পিকনিক সকল মিলে মিশে থাকা হৈচৈ করে সময় কাটাতে মানুষটি বড়ো ভালোবাসতো। 


মা বাবার স্মৃতি ছেড়ে ছেলের ভাড়া বাড়িতে এসে থাকতে রাজি হয়নি। নিজের চারপাশে যেন এক নীরবতার প্রাচির তুলে রেখেছে। মার দিকে তাকালে মনে হয় ধূধূ ফাঁকা মরুভূমি__মায়ের হাসি খুশি মুখখানিতে মন খারাপের ধূসরতা ছেয়ে থাকে সব সময়। 

নিজের ঘর_ বাড়ি, গাছপালা প্রতিটি জিনিসপত্রে বাবার স্পর্শ অনুভব করেই যেন মায়ের সারাদিন কেটে যায়। ভাই বোনেরা জোড় করা সত্ত্বেও কারোর সাথে যেতেই রাজি না হওয়ায়__ প্রত্যেক মাসে কয়েক দিনের জন্য মায়ের কাছে কিছুদিন করে থেকে সবাইকে কর্মস্থলে ফিরতে হয়। সাংসারিক জীবন, কাজের জগতের ব্যস্ততায় নিজেরা কিছুটা সামলে নিলেও বাড়িতে ঘরের ভেতরে বাবার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে মায়ের মনের শূন্যতা দিন দিন বেড়েই চলে।


মার একাকীত্ব দূর করতে ঘর বসে অফিস করার সুবাদে ঋতম মার কাছে সময় সুযোগ মতো এসে থাকছে।বড়ো ছেলে, বউমা_নাতনীকে কাছে পেয়ে কিছুটা মনের দুঃখ ভুলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা__ ছোট্ট নাতনী তিন্নির সাথে গল্প করে তার জেদ, আবদার আনন্দের সঙ্গেই মেটাচ্ছে তার আদরের আম্মা।

দাদুর গল্প, বাবা, পিসিদের ছোটবেলার গল্প,দাদুর ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার নানা মজার কথা,খাওয়া_দাওয়া, শীতে মর্নিংওয়াকে যাওয়ার সময় মাংকি ক্যাপ পড়বে না জন্য টুপি লুকিয়ে রাখা এরকম সুন্দর গল্প শুনে ছোট্ট তিন্নি খুব খুশি। পূজোর রেশ কাটতেই বাতাসে হিমের পরশ। গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়ে যায় "গাছি বা গাছিয়া"দের খেজুর গাছে উঠে হাঁড়ি বাঁধার কাজ। সেই সুস্বাদু রস খাওয়া বাবা নিজে ও সকলের খাওয়ার জন্য সেই রস বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার লোকের ব্যবস্থাও ছিল। ছেলেবেলা থেকে এসব দেখে শুনেই বড়ো হয়েছে। সকালে স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা ও মেয়েকে নিয়ে মর্নিংওয়াকে বের হয়ে কতো পুরোনো দিনের ছেলেবেলার গল্প,বাবার সঙ্গে ঘুরে কাজ দেখে বেড়ানোর কথা ওদের বলতে বলতে সময় কেটে যায়। চোখের সামনে পুরোনো দিনের ছবি ভেসে ওঠে। আজ ওদের বাড়ির কোণে কোণে বিষাদের ছায়া।


ছেলেবেলার পড়াশোনা, স্কুলে যাওয়া, ছুটিতে ঘুরতে যাওয়া। বাবার হাত ধরেই শেখা__ বাজার করা, মাছ চেনা,জিনিসপত্রের ওজন দেখা। ছুটির দিনে দাবা,লুডো,ক্যারামখেলা। শীতে পুতুল নাচ, যাত্রা, সার্কাস দেখতে যাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। মায়ের বকা খাওয়ার ভয়ে লুকিয়ে দোকানের খাবার বাবার সঙ্গে খাওয়া। স্মৃতিচারণায় মনে ভেসে ওঠে অনেক সুখ_দুঃখ, ভাললাগা_ অভিমান, উল্লাসের এক একটা মুহূর্ত।

গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে মাঠ ভরা সোনার ধান দেখে বাঙালির সংস্কৃতি নবান্ন উৎসবের কথা মনে পড়ে। প্রকৃতি এসময়ে অপূর্ব সাজে সজ্জিত হয়ে ধরা দেয়। বিকেলের পড়ন্ত রোদে কৃষকের মাথায় পাকা ধানের আঁটি চকচক করে।আর হাসি ফুটে উঠে ধানের গোলা ভরা সুখে, নতুন বস্ত্রও জিনিসপত্র কেনার আনন্দে।

পথে পথে, উঠোনে_ চাতালে বিছানো ধান। মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে ধানের গন্ধের মাদকতায় মন অস্হির হতে বাধ্য। হেমন্তের প্রাণ এই নবান্ন উৎসব। এ সময়ে গ্রামের লোকজন, পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়_স্বজনদের নিয়ে মেতে থাকে।এ উৎসব শুধু কৃষকের উৎসব নয়__ এ এক ধরনের লোক উৎসব। অতিথি আপ্যায়নের মোক্ষম সময় সকলেই আনন্দে মেতে থাকে। ওদের কাছে পূজোর মতো এটাও বড়ো উৎসব। বাবা বেঁচে থাকলে নবান্নের আয়োজন শুরু হয়ে যেত। সদ্য খেজুর গাছ কেটে হাঁড়িতে জমানো খেজুরের রস হারু কাকার বাড়িতে বড়ো কাঠের উনোনে জ্বাল দেওয়া হচ্ছে দেখতে পায় ওরা। ধীরে ধীরে তৈরী হবে নলেন গুড়___ গন্ধে মাতাল হয়ে উঠবে পাড়া।


শীত মানেই দারুণ ব্যাপার কতো মজা____মেলা, পিকনিক আর সেই সঙ্গে পৌষ পার্বণ আর পিঠেপুলি। 

শীত জাঁকিয়ে পড়তেই শুরু হবে পৌষ পার্বণ। অগ্রহায়ণে নতুন চাল ঘরে উঠলেই তৈরী হত বিভিন্ন ধরনের পিঠেপুলি আর পায়েস। গোকুল পিঠে,রসপুলি, পাটিসাপটা চন্দ্রপুলি কতো তাদের নাম। নামের গরবে গরবিনী স্বাদে গন্ধে সবাই আলাদা। বাড়ির বড়ো ছেলে হওয়ার সুবাদে বাবা মায়ের অনেক কাজেই হাত লাগাতে হতো জন্য অন্য ছোট ভাই বোনদের থেকে ওর অভিজ্ঞতা একটু বেশি ছিল। স্বভাবগত গাম্ভীর্যের জন্য বাবার সাথে ঘনিষ্টতা কম হলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না। শৈশবে ভাই বোনদের খেলা,খুনসুটি আনন্দে বড়ই সুন্দর কেটেছে সেই সময়টা।


শীতের সময় কাজের শেষে বাড়ির কর্তারা বাড়ি ফিরলে মা জেঠিমারা জল খাবার দিতেন সুগন্ধি চাল আর নলেন গুড়ের তৈরী পায়েস, মালপোয়া। বাবা মজা করে বলতো, চাঁদের মত চাঁদপানা মুখ আর চাঁদের আলোর মত স্নিগ্ধ নরম স্বাদের মন ভরানো খাবার নিয়ে হাজির তোদের মা।

এবারো শীত আসছে কিন্তু বাবার ইচ্ছাকৃত ভুল করে মাকে রাগিয়ে দেওয়া, কাগজপত্র, জামাকাপড়ে ঘর অগোছালো করে রাখা, পছন্দের খাবার বানানোর জিনিস কিনে ব্যাগ বোঝাই করে আনা। প্রথমে রাগ দেখালেও পরে মাকেই ঘরের কাজ সেরে সকলের জন্য পিঠেপুলি বানাতে বসতো। খেজুর গুড়ের পায়েস বাবার খুব প্রিয় ছিল।মাকে সাড়া বছর খেজুরের গুড় মুড়ি টিনে মজুত করে রাখতে দেখেছে।এই শীতে সব আয়োজন থাকলেও নেই সেই খাদ্য রসিক মানুষটি__ যে শত কষ্ট হলেও হাসি মুখে আনন্দের সঙ্গে পছন্দের খাবার বানিয়ে প্রিয়জনের হাতে তুলে দেওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকতো। তার জীবনে আজ কালো মেঘের ছায়া___মনে বিষাদের সুর। আজ কোনো খাবারেই ছেলেমেয়েরা পায়না সেই চেনা সুঘ্রাণ____

রাতের আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে চাঁদের জোছনাকে কিছুটা ম্লান করেছে। শিশির ভেজা সকালে সবুজ ঘাসে কুয়াশার ফোঁটায় সকালে সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে অন্য রকম শীতের এক অনুভূতি ____

মৃত্যু বড়ো রূঢ়। প্রিয় মানুষের সঙ্গ ছেড়ে এগিয়ে চলা যেন জীবনের কঠিন বাস্তব। একপাশে সিক্ত চোখে নাতনীর হাত ধরে নীরবে চেয়ে আছে স্বামী হারা অসহায় স্ত্রী। চোখের জলে অনেক কিছু না বলা কথা____পৌষ মাস ওদের পরিবারের সব আনন্দ কেড়ে নিয়ে শূন্যতা ভরে দিয়েছে__। 


উঠোনে পুরোহিত মশাই কলার ডোঙায় চাল সবজি, ফলমূল, মিষ্টি সাজিয়ে বাবার বাৎসরিক অনুষ্ঠান পূজো শুরুর অপেক্ষায় …।।


মুক্ত গদ্য

ভাসান

আগমনী আছে

আগমনী আছে

~ ফড়িং



বাসস্থান গৃহ হয়ে ওঠে ক্রমশ। আলোবোধ, স্নায়ুবোধ ছেড়ে দৃষ্টির দৃষ্টতা জুড়ে ক্ষয় হয় জন্মবোধ। রক্তাক্ত গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে কত শত নদী। নদীর ভেতর জলজ গাছ ও শীতল পাথর। পাথরের দৃঢ়তা ভেঙে মাটির স্বাদ নিতে গিয়ে খসে পড়ে জিভের স্বাদকোরক। জলজ টান ছেড়ে ওঠার পর সমস্ত শরীর জুড়ে নেমে আসে একক, দশক, শতক, হাজার,অযুত, লক্ষ। সমস্ত যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ সেরে ক্লান্ত হয় জরায়ু। মাছেরা ভক্ষণ শেষে সাঁতারের আনন্দ নিতে নিতে ঢুকে পড়ে যে যার মতো। ঢোকার পথ জুড়ে গজিয়ে ওঠে আরও অনেক স্বাদ। সেখানে পাথর ভেঙে ফেলা হয় একের পর এক। চিৎকার আসে। চিৎকারে নেমে আসে মানবজন্ম। আকার নিংড়ে নিয়ে নদীর বাঁধ তৈরী হয়। প্রত্যেকটা বাঁধের পাশে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে জনবসতি। কথা ও বার্তালাপের পর আবারও বসতিতে গড়ে ওঠে বাসস্থান, বাসস্থান থেকে গৃহ। শুরু হয় গৃহ কথা, জন্মকথা। শ্বাসের নাম রাখা হয় নারীত্ব। প্রত্যেকটা শ্বাস প্রত্যেকটা শূন্যতায় দৃঢ় হতে হতে ছাড়িয়ে যায় মাথা, গলা, বুক, পেট। হাতে ও পায়ে জড়িয়ে ধরে গুল্ম। গৃহ জুড়ে গুল্ম গজায়। শ্বাস বেড়ে ওঠে। কখনো ফুলের ছায়ায় আবার কখনো দেওয়াল জুড়ে জন্ম নেয় অবাধ্য শ্যাওলা। তবুও আরও ফুল ফোঁটে। হাসি ফোঁটে। সমস্ত আশ্র‍য়বোধ ও ছায়াটুকু নিয়ে ক্রমশ দীর্ঘ হয় বৃক্ষপট। চার প্রকোষ্ঠ সংকুচিত, প্রসারিত হতে হতে নিশ্বাস ফুরিয়ে আসে অভ্যাস ধরে। প্রতিটি নদীতে স্রোত প্লাবিত হয়। প্লাবিত হয় “যা দেবী সর্ব্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা”। এভাবেই নদী সাগরে মেশে। তারপর তার নাম হয় নারী, সতী অথবা নারীকথা।




আগমনী আছে

আগমনী আছে

আগমনী আছে

~ যাজ্ঞসেনী



এখন শরতের শিউলি ফুলের গন্ধের সঙ্গে মনখারাপ জড়িয়ে থাকে। মাথার ওপর ওই যে ঘন নীলাকাশ, যেখানে রূপকথার মতো খেলা করে সাদা মেঘের দল, সেখান থেকে মা দুগগা আসেন। ওই আকাশে ঘুড়ি উড়তে দেখে ঘুড়িতে লেখা একটা চিঠি পাঠাতে চেয়েছিলাম তার কাছে। আমার চিলেকোঠা ঘর, সুতো, লাটাই,  আশ্বিনের স্বাদমাখা লুকিয়ে রাখা প্রথম নিবেদন, দুরুদুরু অনুভূতি, কাজলে আঁকা আনত চাউনি -- এ সমস্ত ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম দুগগার সঙ্গে। সে চিঠি লেখার আগেই চলে গেল কত কত যে দিন। পেরিয়ে গেলাম কত কত সব রাত। চলে যেতে যেতে  কবে যেন নিজেই  চলে গেলাম নিজের কাছ থেকে। অন্য কোথাও। সেখানে সুখ আছে, স্বাদ নেই। সম্পদ আছে, সম্পর্ক নেই। আগমনী আছে, আস্বাদ নেই। আমি আছি, আমার নেই। ছোটবেলায় সেই চিঠির কথা জানতে পারলে দুগগা নিশ্চয়ই হাসতেন। 

আর এখন? 


গোধূলির বিষণ্ণ আলোমাখা দুগগাও বদলে গেছেন। কখনও কখনও তার চোখেও জল আসে বইকি।


দুগগা এখন শুধুই দুর্গা..


  • অন্দরমহল
  • বর্তমান সংখ্যা
  • আগামী সংখ্যা
  • লেখা পাঠান
  • চালচিত্র
  • যোগাযোগ

হিরণ্যগর্ভ (বাংলা সাহিত্য পত্রিকা)

বেঙ্গালুরু - শিলিগুড়ি

+৯১-৯৯৪৬১৮৬২৩১/ +৯১-৯৭৩৪০০৯৪৪০


Copyright © 2021 hiranyagarvo - All Rights Reserved


Web Design & Concept by Subhradev Sen


An offering of "Hiranyagarvo Publication House"

পৌষ ১৪২৭ সংখ্যা

পড়ুন